Home ইসলামপ্রবন্ধ । দাওয়াহ ইলাল্লাহ: সীরাতের হৃদস্পন্দন

প্রবন্ধ । দাওয়াহ ইলাল্লাহ: সীরাতের হৃদস্পন্দন

by MD JUNAYED SHEIKH
প্রবন্ধ । দাওয়াহ ইলাল্লাহ: সীরাতের হৃদস্পন্দন

ফয়জুল্লাহ আমান

রবিউল আউওয়াল মাস, শুধু এক স্মরণময় উপলক্ষ নয়, বরং বিশ্ববাসীর জন্য নবজাগরণের বার্তা। এই মাসেই পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন সেই মহাপুরুষ, যিনি মানবতার অন্ধকার গলিপথে আলোর প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ﷺ—তাঁর পরিচয় কোনো জাতিগত গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তিনি হলেন তাওহীদের আহ্বানদাতা, বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত।

قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى ٱللَّهِ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ

“বলুন, এ-ই আমার পথ: আমি আল্লাহর পথে আহ্বান করি প্রজ্ঞাসহকারে।”
(সূরা ইউসুফ: ১০৮)

দাওয়াতের সূচনা: মক্কার নীরব বিপ্লব

নবুয়তপ্রাপ্তির পর প্রথম যে শব্দটি তিনি উচ্চারণ করেছেন, তা ছিল “اقْرَأْ”—“পড়ো”। একটি অশিক্ষিত মরুসমাজে তিনি শুরু করলেন জ্ঞান, চিন্তা ও তাওহীদের বিপ্লব। প্রথম তিন বছর তিনি গোপনে দাওয়াত চালিয়েছেন—এটা ছিল কৌশলগত, কিন্তু চিন্তাগত নয়।

তিনি কাউকে হঠাৎ বদলাতে চাননি। তিনি চেয়েছেন অন্তর জাগাতে, আত্মা জাগ্রত করতে, মানুষের বিবেককে প্রশ্ন করতে।

এই সময়েই তিনি গড়েছেন একটি দৃঢ় ভিত্তি—আবু বকর, আলী, খাদিজা, উসমান, যুবায়ের—যাঁদের হৃদয় ছিল আল্লাহর প্রতি একান্ত নিবেদিত।

প্রকাশ্য দাওয়াত: সাহসিকতার এক নতুন অধ্যায়

যখন আল্লাহর আদেশ এল খোলামেলা দাওয়াতের—

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ

“আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তা স্পষ্টভাবে প্রচার করুন।” (সূরা হিজর: ৯৪)

তিনি ডাক দিলেন, খোলাখুলিভাবে। আবু লাহাব, আবু জাহল, ওতবা, শায়বা—সমাজের রথী-মহারথীরা একযোগে বিদ্বেষে ফেটে পড়ল। তবুও তিনি বললেন—

قولوا لا إله إلا الله تفلحوا

“বলো, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই—তবে তোমরা সফল হবে।”

দাওয়াতের কৌশল: প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও বাস্তবতা

নবীজী ﷺ ছিলেন দাওয়াতের সর্বোচ্চ কারিগর। তিনি সবার সাথে একরকম ব্যবহার করেননি—বুঝেছেন মানুষের মনস্তত্ত্ব, অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি।

আবু জাহলদের জন্য কঠিন সত্য

উমর ইবনে খাত্তাবের জন্য যুক্তি ও চ্যালেঞ্জ

মুসআব ইবনে উমায়েরের মাধ্যমে যুবসমাজে দাওয়াত

মুক্ত ক্রীতদাসদের কাছে মুক্তির বাণী

ইহুদিদের কাছে নবুওতের দলিল

খ্রিষ্টানদের কাছে ইবরাহিমি মিলনরেখা

তাঁর দাওয়াতে ছিল না তাচ্ছিল্য, বিদ্বেষ, অপমান বা জবরদস্তি। বরং ছিল—

ٱدْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلْحِكْمَةِ وَٱلْمَوْعِظَةِ ٱلْحَسَنَةِ

“আপনার রবের পথে আহ্বান করুন প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে।” (সূরা নাহল: ১২৫)

তাওহীদের আলো ও দাওয়াতের বিস্তার

দশ বছর মক্কায় তিনি ছিলেন তাওহীদের একক বার্তাবাহক—বিনা অস্ত্রে, বিনা শক্তিতে। কিন্তু আল্লাহ তাঁর দাওয়াতকে এমন শক্তিতে রূপান্তরিত করলেন, যা পুরো আরবকে কাঁপিয়ে দিল।

মদিনায় তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠেন, কিন্তু তাঁর মুখে তাওহীদের কথা চলমান; বরং তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এমন এক সমাজ, যেখানে একমাত্র আল্লাহর বন্দেগি জীবনের চালিকাশক্তি।

বিদায়ী হজ্ব: দাওয়াতের চূড়ান্ত পরিণতি

শেষ সময়ে এসে তিনি আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেন—

أَلَا هَلْ بَلَّغْتُ؟

“বলুন তো, আমি কি পৌঁছে দিয়েছি (বার্তা)?”
সাহাবিরা বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।” তিনি বললেন—
اللهم فاشهد
“হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।”

এবার দায়িত্ব তাঁর উম্মতের হাতে।

শেষ কথা: আমরা কি দাওয়াতের উত্তরাধিকার বহন করছি?

আজ আমরা অনেক কিছু নিয়ে গর্ব করি—ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা। কিন্তু নবীজীর ﷺ প্রকৃত উত্তরসূরি হতে হলে আমাদের দায়িত্ব একটাই—তাঁর মতো করে দাওয়াতি প্ররণায় উদ্দীপিত হওয়া।

তাঁর দাওয়াত ছিল কোনো গ্রুপের জন্য নয়, গোত্রের জন্য নয়—মানবতার জন্য।

আল্লাহর তাওহীদের বাণী, আখিরাতের ভয়, কুরআনের দাওয়াত, ন্যায় ও দয়ায় নির্মিত জীবন—এই ছিল তাঁর দাওয়াতের মূল।

এটা কেবল মুখে বলার বিষয় নয়; বরং হৃদয়ে ধারণ করে মানুষকে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সত্যের পথে ডাকার নামই হলো দাওয়াত।

আজকের দুনিয়ায়, যেখানে বিভ্রান্তি ও বস্তুবাদে মানুষ পথ হারিয়েছে, সীরাতে নববী আমাদের বলে—

“হে আমার উম্মত! দাঁড়িয়ে পড়ো। জাগাও বিশ্ববিবেক। তোমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি!”

প্রিয় নবী সাঃ এর এই আহবান আমাদেরকে শুনতে হবে। হতে হবে দাওয়াতি চেতনায় উজ্জীবিত। প্রফুল্ল চিত্তে এগিয়ে যেতে হবে দাওয়াহ ইলাল্লাহর পথে। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment