
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের লোগোছবি: আল–জাজিরার ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া
ইরানে সাম্প্রতিক হামলায় গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের নিশানা করার পেছনে বহু বছর ধরে গড়ে তোলা গোয়েন্দা পরিকল্পনা ছিল, এমনটাই জানাচ্ছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো।
ইসরায়েলের হামলায় ইরানের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোর বড় অংশ ধ্বংস হয়েছে ও বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। এসবের নেপথ্যে রয়েছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। সংস্থাটির দাবি, তারা ইরানের নিরাপত্তা কাঠামোর বড় অংশেই অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে।
ইরানের ভেতরে অনেককে মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা, ইসরায়েলের পক্ষে প্রচারণা চালানো কিংবা জনমতকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কয়েক দিন আগে ইরান সরকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা টিমকে নির্দেশ দিয়েছে, তারা যেন ইন্টারনেট-সংযুক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার না করে; যাতে ইসরায়েলি হ্যাকিং থেকে গোপন তথ্য রক্ষা করা যায়। ইতিমধ্যে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা জনগণকে অনুরোধ করেছে, গত কয়েক বছরে তাঁরা কোনো ভবন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিয়ে থাকলে, সে সম্পর্কে যেন কর্তৃপক্ষকে জানান।
মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইরানে এ ধরপাকড় শুরু হয়েছে ইসরায়েলের নজিরবিহীন গোয়েন্দা অভিযানের জের ধরে। তাদের এ গোয়েন্দা অভিযানের ফলেই ইরানে বেছে বেছে ইসরায়েল হামলা করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে ইরান সরকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা টিমকে নির্দেশ দিয়েছে, তারা যেন ইন্টারনেট-সংযুক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার না করে; যাতে ইসরায়েলি হ্যাকিং থেকে গোপন তথ্য রক্ষা করা যায়। ইতিমধ্যে, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা জনগণকে অনুরোধ করেছে, গত কয়েক বছরে তাঁরা কোনো ভবন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিয়ে থাকলে, সে সম্পর্কে যেন কর্তৃপক্ষকে জানান।
ইরানে হামলায় মোসাদের ভূমিকা কতটা
ইরানে ইসরায়েলের হামলায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মোসাদের গোয়েন্দারা। হামলার পরপরই আন্তর্জাতিক ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমে বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ে ইসরায়েলি গোয়েন্দা তৎপরতার নানা বিবরণ।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানান, কীভাবে মানব গোয়েন্দা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) একসঙ্গে ব্যবহার করে আঘাত হানা হয়েছে, যার ফলে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
হামলার কয়েক দিন পর ১৭ জুন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীর ১০ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে।

ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত একটি অ্যাম্বুলেন্সের পাশে ইরানের পতাকা ধরে আছেন এক ব্যক্তি। তেহরান, ইরান, ২৩ জুন ২০২৫ছবি: এএফপি
মোসাদের সাবেক গবেষণা পরিচালক সিমা শাইন এপিকে বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিশানা করার জন্য মোসাদ বহু বছর ধরে যে পরিকল্পনা করে আসছিল, এ হামলা ছিল তারই চূড়ান্ত রূপ।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি এজেন্টরা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গোপনে ইরানে প্রবেশ করান। এগুলো ব্যবহার করে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়। এসব লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে একটি মার্কিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল। এ মডেল ইরানের ভেতরের ইসরায়েলি এজেন্টদের দেওয়া তথ্য ও অতীত হামলা থেকে সংগৃহীত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দেয়।
ইরানে এখন ইসরায়েলের ৩০ থেকে ৪০টি সক্রিয় সেল থাকতে পারে। এর বেশির ভাগই ইসরায়েলি এজেন্ট নয়; বরং স্থানীয় সহযোগী। কোনো সেল অস্ত্র পাচারে যুক্ত, কেউ হামলা চালায়, আবার কেউ শুধু তথ্য সংগ্রহ করে।
হামজা আত্তার, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক
এ গোয়েন্দা অভিযান কি এখনো চলছে
প্রমাণগুলো দৃশ্যত সেদিকেই ইঙ্গিত করে।
গত সপ্তাহান্তে ইরানের কুদস বাহিনীর দুই শীর্ষ কর্মকর্তা সাঈদ ইজাদি ও বেনাম শাহরিয়ারি নিহত হন। ইসরায়েল দাবি করেছে, তাঁদের অবস্থান নির্ণয় করেছে (ইরানে সক্রিয়) ইসরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক।
এর আগে ১৭ জুন ইরানের আরেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল আলি শাদমানি নিহত হন, এটা ছিল তাঁর পূর্বসূরিকে লক্ষ্য করে চালানো হামলার মাত্র চার দিন পর।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য অবজারভারে ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা বিশ্লেষক মিরি আইসিন বলেন, ‘মানুষ বুঝতেই পারে না, আমাদের দুঃসাহস কতটা।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো লক্ষ্য যদি নিজেকে ইন্টারনেটযুক্ত সব যন্ত্র থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না করে, তবে আমরা তাদের খুঁজে নিতে পারি। অধিকাংশ মানুষই তা করে না। আমরা যে কাউকে হাতের নাগালে পেতে পারি।’
লুক্সেমবার্গ থেকে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইরানে এখন ইসরায়েলের ৩০ থেকে ৪০টি সক্রিয় সেল থাকতে পারে। এর বেশির ভাগই ইসরায়েলি এজেন্ট নয়; বরং স্থানীয় সহযোগী।’
এ বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘কোনো সেল ইসরায়েল থেকে অস্ত্র পাচার করে আনায় যুক্ত, কেউ হামলা চালায়, আবার কেউ শুধু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজ করে। ইরানি কর্তৃপক্ষের জব্দ করা যন্ত্রাংশ বিশ্লেষণ করে অনেক সময় বোঝা যায়, ইসরায়েলি এজেন্টরা কোথায়, কোন উদ্দেশ্যে এগুলো ব্যবহার করছিল।’
ইসরায়েলি এজেন্টরা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গোপনে ইরানে প্রবেশ করায়। এগুলো ব্যবহার করে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়। এসব লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে একটি মার্কিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল। এ মডেল ইরানের ভেতরের ইসরায়েলি এজেন্টদের দেওয়া তথ্য ও অতীত হামলা থেকে সংগৃহীত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দেয়।
এ তৎপরতা কত দিন ধরে চলছে
ইরানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা অভিযান নতুন নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭৯ সালের ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই দেশটিতে নজরদারি, অনুপ্রবেশ, নাশকতা এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ইসরায়েল বিভিন্ন ধরনের অভিযান চালিয়ে আসছে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা আলী লারিজানি দেশটিতে ইসরায়েলি অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি খুবই জটিল আকার ধারণ করেছে।’
ইরানি পার্লামেন্টের সাবেক এ স্পিকার ও পরমাণু মধ্যস্থতাকারী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই কিছু বিষয়ে অবহেলা ছিল।’
মানুষ বুঝতেই পারে না, আমাদের দুঃসাহস কতটা। কোনো লক্ষ্য যদি নিজেকে ইন্টারনেটযুক্ত সব যন্ত্র থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না করে, তবে আমরা তাদের খুঁজে নিতে পারি। অধিকাংশ মানুষই তা করে না। আমরা যে কাউকে হাতের নাগালে পেতে পারি।
মিরি আইসিন, ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা বিশ্লেষক
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর বেশ কিছু পেজার বিস্ফোরিত হয়, যা এ ডিভাইসের সরবরাহব্যবস্থায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার অনুপ্রবেশের ফল বলেই মনে করা হয়।
হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াকেও ইসরায়েলের পরিকল্পিত গুপ্তহত্যার শিকার হতে হয়েছে। বিশেষ করে হানিয়ার বাসায় সপ্তাহখানেক আগে বসানো একটি বিস্ফোরক দিয়েই তাঁকে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি ঘটে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে, তেহরানে।

মোসাদের প্রধান ডেভিড বার্নিয়াছবি: রয়টার্স
গত দুই দশকে ইসরায়েল একাধিক ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহসেন ফাখরিজাদে, যাঁকে একটি চালকবিহীন ট্রাকে বসানো রিমোটচালিত বন্দুক দিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১০ সালে ইরানে ১৪টি পারমাণবিক স্থাপনায় প্রায় ৩০ হাজার কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এটি ‘স্টাক্সনেট’ নামের কম্পিউটার ভাইরাস, যেটির জন্যও ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়।
ইরানও কি ইসরায়েলে গোয়েন্দা তৎপরতা চালায়
নিশ্চয়ই।
২০২৪ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত জানায়, তারা সাত ইসরায়েলি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে, যাঁরা ইরানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিলেন।
এ ঘটনার এক দিন আগেই হাইফায় আরও সাতজনকে আটক করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ইরানের গোয়েন্দা বিভাগের হয়ে যুদ্ধকালে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়।
সে সময় ইসরায়েলি পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দেশে ইরানের হয়ে কাজ করা আরও অনেক গোপন নেটওয়ার্ক সক্রিয় থাকতে পারে।