মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
তারা উধাও হওয়া এক রাতের কথা। চারদিকে ছেয়ে আছে অন্ধকার। কাবা শরিফ তাওয়াফ করে ঘরে ফিরলেন খাদিজা (রা.)। হাতের টুকটাক কাজ সারলেন। এলেন বিছানায়। ধীরে ধীরে ঢলে পড়লেন ঘুমের কোলে। গভীর রাত। ঘুমে বিভোর গোটা আরব। সাড়াশব্দ নেই কোথাও। হঠাৎ স্বপ্নে দেখলেন, আকাশ থেকে একটি চাঁদ নেমে এলো তার কোলে। সারা ঘর আলোকিত হয়ে উঠল তাতে। খাদিজা (রা.)-এর জ্ঞানী এক চাচাতো ভাই ছিলেন। নাম ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল। পার্থিব ও ধর্মীয় জ্ঞানে তিনি সমস্ত আরবে বিখ্যাত ও সর্বজন মান্য ছিলেন। খাদিজা (রা.) তার কাছে আগেকার নবী-রাসুল, ধর্ম ও আসমানি কিতাবের বিভিন্ন ঘটনা শুনতেন।
স্বপ্ন যখন সুসংবাদ
ঘুম ভেঙে গেল খাদিজা (রা.)-এর। বিচলিত হলেন খুব। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন বারবার। রাতের অন্ধকার দূর হয়ে গেল একসময়। ভোরের আলো ফুটল। সোজা চলে গেলেন ওয়ারাকার কাছে। স্বপ্নের কথা খুলে বললেন তাকে। বিস্তারিত শুনলেন ওয়ারাকা। বললেন, ‘তোমার জন্য সুসংবাদ। তুমি যদি সত্যিই এমনটা দেখে থাক, তবে এর ব্যাখ্যা হলো— শেষ যুগে এক নবী আসবেন। তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে। তার দ্বারা তোমার ঘর আলোকিত হবে। তার মাধ্যমেই নবী আসার ধারাবাহিকতা শেষ হবে।’
নেক কাজে মন
কী শুনলেন খাদিজা (রা.)! কী বলছেন তার চাচাতো ভাই! হতচকিত হলেন তিনি। সারা শরীরে খেলল অদ্ভুত শিহরণ। আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসার ঢেউ বয়ে গেল মনে। অপার্থিব আশা বুকে অধীর আগ্রহে কাটাতে লাগলেন দিন। স্বপ্নের ব্যাখ্যার বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষা করতে লাগলেন। কখন তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে! কে সেই জগৎ আলোকিতকারী মানবতার সর্বোত্তম মহাপুরুষ? অপেক্ষায় তিনি অধিকহারে ভালো কাজ করতে লাগলেন। কোরাইশের নেতৃস্থানীয় যুবকেরা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছিল। তিনি নাকচ করছিলেন। স্বপ্নে দেখা মহারহস্য উদ্ঘাটনে বারবার পিছু হটতে লাগলেন। ওয়ারাকার মুখে শোনা ব্যাখার কথা ভাবতে লাগলেন।
সূক্ষ্ম জ্ঞানে নির্বাচন
খাদিজা (রা.) ছিলেন ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। মজুরির বিনিময়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। কোরাইশদের মাঝে ব্যবসায়িক জ্ঞানে বাণিজ্য পরিচালক হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। ধী-শক্তি আর সৌন্দর্যে, দৃঢ় চরিত্র ও নরম হৃদয়ের সম্মিলন ঘটেছিল তার মনে। এ সকল গুণ তাকে দিয়েছিল সূক্ষ্ম জ্ঞান; সঙ্গে মানুষ আর ঘটনা বিচার করার পরিপক্ক ক্ষমতা। খাদিজা (রা.) জানতে পারলেন, কথাবার্তায় সত্যবাদী, আমানত যথাযথ রক্ষাকারী এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী মক্কায় একজন আছেন। তিনি লোক পাঠালেন তার কাছে। বললেন, ‘অন্যরা আপনাকে যে পারিশ্রমিক দেবে, আমি তার দ্বিগুণ দেব।’ লোকটি তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)।
পাদ্রীর অবাক চাহনী
খাদিজা (রা.)-এর এক বালক দাস ছিল। নাম মাইসারা। তাকে নিয়ে প্রিয় নবী (সা.) সিরিয়ার পথ ধরলেন। পথিমধ্যে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। পুরনো একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নিলেন। কাছেই একটি প্রাচীন গির্জা ছিল। সেখানকার পাদ্রী এদিকে মনোযোগ দিলেন। নিরীক্ষণ করলেন তাদের। মাইসারার কাছে সফরসঙ্গীর পরিচয় জানতে চাইলেন। মাইসারা বলল, ‘তিনি কাবার পাশে বসবাসকারী সম্ভ্রান্ত কোরাইশি।’ পাদ্রী বললেন, ‘আশ্চর্য! এ গাছের নিচে নবী ছাড়া কখনও কেউ বিশ্রাম নেয়নি!’ (তাবাকাতে ইবনে সাআদ : ১/১২৯)।
দাসের শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা
রাসুলুল্লাহ (সা.) সিরিয়ার বাজারে পণ্য বিক্রি করলেন। যা কেনার ছিল, কিনে নিলেন। তারপর মাইসারাকে সঙ্গে করে মক্কার পথে রওনা হলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) উটের পিঠে চড়ে পথ চলছেন। দুপুরের প্রচণ্ড রোদ। দুজন ফেরেশতা মেঘের আকারে তার মাথার ওপর ছায়া দিলেন। মাইসারা বিষয়গুলো খেয়াল করল। ব্যবসায় প্রায় দ্বিগুণ লাভ হলো। মাইসারার মনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালেবাসা সৃষ্টি হলো। সে তার দাসে পরিণত হলো। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ৮৮-৮৯)।
পরম আকাঙ্ক্ষা
মক্কায় ফিরলেন তারা। সফরের সব কথা বিশ্বস্ততার সঙ্গে মাইসারা খাদিজা (রা.)-কে জানাল। খাদিজা (রা.) ভাবনায় ডুবে গেলেন। বিস্মিত মনে ভাবতে লাগলেন, ব্যবসা চলাকালে প্রিয় নবী (সা.)-এর আমানতদারি, কর্মীর সঙ্গে সদাচার, লোভহীন ব্যবসা পরিচালনা, পাদ্রীর মন্তব্য, মেঘের ছায়াদান, দ্বিগুণ লাভ, ওয়ারাকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যদ্বাণী। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আচার-আচরণ, ন্যায়-নিষ্ঠা, কোমল ব্যবহার গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন তিনি। বিরল প্রতিভার অধিকারী এ ব্যক্তিই সেই কাঙ্ক্ষিত পুরুষ, তার মনে এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ রইল না। তাকে নিজের করে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগল।
বান্ধবীর সঙ্গে আলাপন
খাদিজা (রা.) উচ্চ বংশের সম্মানিতা নারী। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে স্বামী হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছা করলেও সরাসরি প্রস্তাব দিলেন না। সংযমের সঙ্গে অন্যকে মাধ্যম বানালেন। ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনিয়ার কাছে কৌশলে বিষয়টি তুলে ধরলেন। নাফিসাকে জানালেন, ‘মুহাম্মদ অসামান্য ও অনন্য চরিত্রের অধিকারী।’ নাফিসা নিজেও জানতেন, মুহাম্মদ (সা.) কেমন! খাদিজা (রা.)-এর মুখ থেকে প্রশংসা শুনেই নাফিসা (রা.) বলে উঠলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, মুহাম্মদ তোমার প্রেমময় স্বামী হতে পারেন।’
বিয়ের প্রস্তাবনা
নাফিসা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে গেলেন। তার মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করলেন। একপর্যায়ে জানতে চাইলেন, ‘আপনি বিয়ে করছেন না কেন?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘বিয়ে করার জন্য যে সম্পদের দরকার, তা এখনও অর্জন করতে পারিনি।’ নাফিসা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি আপনার বিয়েতে সেই সম্পদের দরকার না পড়ে; আর যদি একজন বিত্তবান সুন্দরী নারী কোনো কিছুর দাবি ছাড়াই আপনাকে বিয়ে করতে চান, তাহলে আপনার কী অভিমত?’
বিয়ের ফুল ফোটা
রাসুলুল্লাহ (সা.) জানতে চাইলেন, ‘কে সেই নারী?’ নাফিসা (রা.) জবাব দিলেন, ‘খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘খাদিজা কি আমাকে গ্রহণ করবেন?’ নাফিসা (রা.) বললেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি।’ শুভ সংবাদ নিয়ে খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরলেন নাফিসা (রা.)। বিয়ের রীতি অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.) তার চাচা আবু তালেব, হামজা ও অন্যদের জানালেন। আবু তালেব খাদিজা (রা.)-এর চাচা আমর বিন আসাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হলো।
ভালোবাসা প্রকাশ
বিয়ের পরদিন; খাদিজা (রা.) পশু জবাই করলেন। গরিব-মিসকিনদের খাওয়ালেন। আত্মীয়-স্বজনদের জন্য ঘর খুলে দিলেন। বিয়ের সময় তার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক। এ পবিত্র বিয়ের মাধ্যমে খাদিজা (রা.)-এর পূর্ণাঙ্গ ভালোবাসা প্রকাশ পায়। তিনি হন দয়া, অনুগ্রহ ও ভালোবাসার জননী। (নিসাউ আহলিল বাইত : ১৬-১৯)।
লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ