Home ইসলামসিরাত সংখ্যা। নবীজির পারিবারিক জীবন : আদর্শ স্বামী ও পিতা

সিরাত সংখ্যা। নবীজির পারিবারিক জীবন : আদর্শ স্বামী ও পিতা

by .
সিরাত সংখ্যা। নবীজির পারিবারিক জীবন : আদর্শ স্বামী ও পিতা


মাওলানা আবদুল হালীম


প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নামের পারিবারিক জীবন ছিল অত্যšত্ম সুন্দর, আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ। বিশেষ করে স্বামী ও পিতা হিসেবে ছিলেন আদর্শ, সংবেদনশীল, ন্যায়পরায়ণ ও ভালোবাসায় পূর্ণ। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জন্য শিক্ষার উৎস। তিনি তাঁর পরিবারে একজন দায়িত্বশীল স্বামী, মমতাময় পিতা, স্নেহশীল দাদা এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
নিচে তাঁর পারিবারিক জীবনের কিছু গুরম্নত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:

স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা
নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম তাঁর স্ত্রীদের প্রতি অত্যšত্ম স্নেহশীল ও সম্মান দেখাতেন। আম্মাজান হযরত খাদিজা রাযি. ছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী। তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে নবীজিকে সমর্থন দেন, এবং নবীজি তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁকে সবসময় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করতেন।

স্বামী হিসেবে নবীজির জীবন ছিল উত্তম আদর্শের নমুনা। তিনি হযরত খাদিজা রাযি. ছাড়াও অন্যান্য স্ত্রীদের প্রতি ছিলেন অত্যšত্ম স্নেহশীল ও শ্রদ্ধাশীল। কখনো তিনি তাদের অবহেলা করতেন না, বরং ভালোবাসা ও সম্মান প্রকাশ করতেন। পবিত্র হাদীস থেকে জানা যায়, একবার রাসূলুলস্নাহ সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘হে আলস্নাহর রাসূল! আপনি মানুষদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন?’ তিনি বললেন, আয়েশাকে। জিজ্ঞেস করা হলো: আর পুরম্নষদের মধ্যে? তিনি বললেন, তার (আয়েশার) পিতাকে। (জামে তিরমিযী, হাদীস: ৩৮৯০)

পারস্পরিক বোঝাপড়া ও রসিকতা
নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম স্ত্রীদের সঙ্গে খোলামেলা ও হাস্যরসপূর্ণ আচরণ করতেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, ‘আমি রাসূল সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম-এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছিলাম এবং আমি জিতে গিয়েছিলাম। পরে আবার দৌড় দিলে তিনি আমাকে হারিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘এইবার তোমার আগের জয়ের প্রতিশোধ নিলাম।’ (আবু দাউদ, হাদীস: ২৫৭৮)

স্ত্রীদের মতামতের প্রতি সম্মান
নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম স্ত্রীদের পরামর্শ নিতেন এবং গুরম্নত্ব দিতেন। হুদায়বিয়া চুক্তির সময় নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম তাঁর স্ত্রী আমাদের মা আম্মাজান হযরত উম্মে সালামা রাযি.-এর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। হযরত উম্মে সালামা রাযি. বললেন, ‘আপনি আগে নিজে কুরবানি করম্নন, এরপর সাহাবিরাও করবে। নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম তাই করলেন, সাহাবারাও তাঁর অনুসরণ করলেন। (বুখারী শরীফ, হাদীস: ২৭৩১)

নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম কখনও স্ত্রীদের ওপর হাত তোলেননি, বরং সবসময় নম্রতা, ধৈর্য ও সদাচরণে তাদের সঙ্গে আচরণ করেছেন। স্ত্রীদের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের কথায় গুরম্নত্ব দেওয়া এবং ঘরের কাজেও সহযোগিতা করা তাঁর অন্যতম গুণ ছিল।

পরিবারে ন্যায়বিচার ও ভারসাম্য
একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম সকলের প্রতি সমান আচরণ করার চেষ্টা করতেন। সময় ও সম্পদ বণ্টনে ন্যায়বিচার করতেন এবং স্ত্রীদের আগ্রহ ও নেক আবেদনকে গুরম্নত্ব দিতেন।

ভালোবাসা প্রকাশে অকুণ্ঠতা
নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম স্ত্রীদের ভালোবাসা প্রকাশ করতেন এবং কখনো গোপন করতেন না। সাহাবিরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি অকপটে বলতেন, “আমি খাদিজাকে ভালোবাসি”, “আমি আয়েশাকে ভালোবাসি”।

ঘরোয়া জীবনে নম্রতা ও সহযোগিতা
নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম নিজ হাতে কাপড় সেলাই করতেন, জুতা সেলাই করতেন এবং নিজের কাজ নিজে করতেন। হাদীসে আছে, ‘তিনি ঘরে থাকলে পরিবারের কাজে সাহায্য করতেন, আর আজান শুনলে নামাজের জন্য বের হয়ে যেতেন। (বুখারী শরীফ, হাদীস : ৫৭৬)

সšত্মানদের প্রতি ভালোবাসা ও আদর্শ অভিভাবকত্ব
তাঁর ছয়জন সšত্মান ছিল, তাদের মধ্যে হযরত ফাতিমা রাযি. ছিলেন বিশেষ প্রিয়। তিনি সšত্মানদের স্নেহ দিতেন, তাদের খেলাধুলা করতেও উৎসাহ দিতেন এবং চরিত্র গঠনে গুরম্নত্ব দিতেন।

পিতা হিসেবেও নবীজির জীবন উত্তম আদর্শের নমুনা ছিল। তিনি সšত্মানদের প্রতি ছিলেন অত্যšত্ম স্নেহশীল ও সহানুভূতিশীল। সšত্মানদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা। তিনি তাদের কোলে নিতেন, চুমু দিতেন, খেলাতেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন, ‘আমি নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নামকে দেখেছি, তিনি হযরত হাসান রাযি.-কে চুমু দিচ্ছেন। একজন বেদুইন বললেন, আমি আমার ১০ সšত্মানকে কখনো চুমু দিইনি। নবীজি বললেন, ‘যে ব্যক্তি দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না।’ (বুখারী শরীফ, হাদীস: ৫৯৯৭, মুসলিম শরীফ, হাদীস: ২৩১৮)

হযরত ফাতিমা রাযি.-এর প্রতি বিশেষ ভালোবাসা ও মর্যাদা
হযরত ফাতিমা রাযি. ছিলেন নবীজির প্রিয় কন্যা। তিনি যখন নবীজির ঘরে আসতেন, নবীজি উঠে দাঁড়াতেন, তাঁকে চুমু দিতেন, পাশে বসাতেন। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, “আমি কখনো কাউকে রাসূলুলস্নাহ-এর চেয়ে অধিক সদ্ব্যবহারকারী দেখিনি। যখন ফাতিমা রাযি. আসতেন, নবীজি তাঁকে স্বাগত জানিয়ে চুমু দিতেন এবং নিজের আসনে বসাতেন।” (জামে তিরমিযী, হাদীস: ৩৮৭২)

সšত্মানদের ইসলামী শিক্ষায় আগ্রহ


নবীজি তাঁর সšত্মানদের এবং নাতীদের দ্বীনির শিক্ষার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম বলেন, “হাসান ও হুসাইন এই দুইজন আমার দুনিয়ার ফুল।” (বুখারী শরীফ, হাদীস: ৩৭৪৮)
তিনি হাসানকে একদিন বলেছিলেন, ‘হে আলস্নাহ! আমি তাকে ভালোবাসি, আপনি তাকে ভালোবাসুন।’ (বুখারী শরীফ, হাদীস: ৩৭৪৯)

ভালোবাসা দুই দিক থেকেই হতে হয়


রাসূল সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম স্ত্রী সšত্মানদের ভালোবেসেছেন, তাঁরা নিজের জীবনের চেয়েও বেশি রাসূল সা.-কে ভালোবাসতেন। রাসূল সা.-এর কষ্ট তাঁদের জন্য ছিল সহ্য সীমার বাইরে।
একবার কুরাইশের কিছু লোককে আবু জাহেল বলল, কে যাবে এবং বনি ফুলান গোত্রের উটের পেটে যা আছে অর্থাৎ নাড়িভুঁড়ি) তা এনে মুহাম্মদের (সা.) কাঁধের উপর রেখে দেবে, যখন সে সিজদায় যাবে? একজন এগিয়ে গেল এবং সেই নাপাক জিনিস এনে রাসূল সা. সিজদায় গেলে তাঁর পিঠের উপর ফেলে দিল। রাসূল সা. তখন সিজদায়ই ছিলেন। এ খবর শুনে হযরত রাযি. ছুটে এলেন। তিনি সেই অপবিত্র জিনিসগুলো সরিয়ে দিলেন তারপর কান্না করলেন। (বুখারী ও মুসলিম, হাদীস : ২৪০, ১৭৯৪)
রাসূলের জীবনের শেষ সময়ে যখন তিনি অসুস্থ ছিলেন, হযরত ফাতেমা রাযি. তাঁকে দেখে কাঁদতে লাগলেন। তখন রাসূল সা. তাঁর কানে কিছু বললেন, এতে তিনি আরও কাঁদলেন। পরে আবার কিছু বললেন, এতে তিনি হেসে উঠলেন। পরে হযরত ফাতেমা রাযি. জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, প্রথমে রাসূল সা. বললেন, ‘আমি দুনিয়া থেকে চলে যাব’ তাতে আমি কেঁদে ফেলি। পরে বললেন, ‘তুমি আমার পরিবারে প্রথম ব্যক্তি, যে আমার পরে মারা যাবে। এতে আমি খুশি হই এবং হাসি। (বুখারী ও মুসলিম)
এই হাদীস ও ঘটনা থেকে বোঝা যায়, হযরত ফাতেমা রাযি. ছিলেন তাঁর বাবার প্রতি গভীর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একজন কন্যা, যিনি তাঁর দুঃখ, কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না।

উপসংহার
হযরত মুহাম্মদ সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম একজন আদর্শ স্বামী ও পিতা ছিলেন। তাঁর পারিবারিক জীবন আমাদের শিক্ষা দেয়, ভালোবাসা ও সম্মান কিভাবে পরিবারের ভিত মজবুত করে, ধৈর্য, সহানুভূতি ও পরামর্শ কিভাবে সংসারে শাšিত্ম আনে, আর সšত্মানদের ভালোবাসা ও সঠিক শিক্ষায় কিভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে ওঠে।
মোটকথা : নবীজি সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নামের পারিবারিক জীবন ছিল এক আদর্শ জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন- কীভাবে একজন মানুষ তার পরিবারের দায়িত্ব পালন করবে, কীভাবে ভালোবাসা ও মর্যাদা দিয়ে পরিবারকে গড়ে তুলবে। তাঁর জীবন আজও এবং কিয়ামত পর্যšত্ম আমাদের জন্য অনুসরণীয় পথনির্দেশ।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment