Home মুক্ত গদ্যজীবনচরিত। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ: এক জাগ্রত চেতনার প্রতীক

জীবনচরিত। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ: এক জাগ্রত চেতনার প্রতীক

by .
জীবনচরিত। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ

মুফতি তামীমুল ইসলাম ফরিদী

ইতিহাসের ধারায় কিছু মানুষ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মনোনীত হয়ে আসেন যারা সময় ও সমাজকে আলোকিত করেন জ্ঞান, হিকমাহ ও আধ্যাত্মিকতার আলোয়। বাংলাদেশে এমন ব্যক্তিত্বদের তালিকায় শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি কেবল একজন উস্তায নন, বরং এক চলমান প্রতিষ্ঠান, চিন্তার এক উর্বর ভাণ্ডার, দ্বীনি নেতৃত্বের এক মজবুত মিনার, আত্মিক পরিশুদ্ধতার পথপ্রদর্শক।

শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহর শৈশব থেকেই দ্বীনের প্রতি অনুরাগ ছিল প্রবল। প্রথাগত কওমি ধারায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর, তিনি উচ্চতর দীনি ও প্রজ্ঞাময় শিক্ষার উদ্দেশ্যে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মাদারিসে ইলমী দারুল উলুম দেওবন্দ সফর করেন। তিনি এমন সব শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসেন, যারা দেওবন্দিয়্যতের রুহানি দ্যুতি বহনকারী ছিলেন। তাঁর চিন্তাচর্চায় কিতাবি গভীরতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাস্তবতাবোধ, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, ইসলামের বিশ্বময় বার্তা ও ইসলামি দাওয়াতের চূড়ান্ত ভারসাম্য।

তাঁর শিক্ষাদান: একটি জীবন্ত প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া

তিনি যে শুধু কিতাব পড়ান তা নয়—তিনি মানুষের অন্তর প্রস্তুত করেন। তাঁর ক্লাস, বক্তব্য ও পরামর্শে শিক্ষার্থীরা কেবল শব্দ শেখে না, বরং আত্মিক দরদ, উম্মাহর প্রতি ভালোবাসা ও আত্মশুদ্ধির চেতনা অর্জন করে। একজন শিক্ষার্থীর হৃদয়গঠনে তিনি নিম্নোক্ত মৌলিক বিষয়ের উপর জোর দেন: ১ আদব ও বিনয়: বড়দের প্রতি বিনয়, মতবিরোধে ইনসাফ। ২ চিন্তার পরিশুদ্ধি: দ্বীনের মাসআলা-মাসায়েলের পাশাপাশি বাস্তবতার সাথে মিল রেখে সমাধান ভাবা। ৩ আত্মিক উন্নয়ন: জিকির-ফিকির, তাওবা, খুশু ও খুযু’র অনুভূতি উন্নত করা। ৪ আকাবিরদের প্রতি প্রেম: পূর্বসূরি উলামায়ে দেওবন্দের পদ্ধতি ও চেতনা হৃদয়ে ধারণ করা।

আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্দৃষ্টি

তিনি এমন একজন রূহানী শায়েখ, যিনি কেবল বাহ্যিক আমলের উপর নয়—অন্তরের তাযকিয়ার উপরও জোর দেন। তার সোহবতে মানুষ গুনাহ থেকে তাওবা করে, দ্বীনের গভীরতায় প্রবেশ করে এবং অন্তরের শান্তি লাভ করে। তিনি যুগের দুর্বলতাগুলো বিশ্লেষণ করে তা থেকে বাঁচার পথ দেখান এবং আত্মিক শক্তি জোগান।

বিতর্ক-সমালোচনার মুখে তাঁর অবস্থান: ছাত্রদের এককাট্টা অবস্থান

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন বহু সময় এসেছে, যখন তাঁকে নানা রাজনৈতিক বা আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আক্রমণ করা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, তাঁর ছাত্রসমাজ তাঁকে নিয়ে সমালোচনা করেনি; বরং আরও বেশি শ্রদ্ধায় আবিষ্ট হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে: ১. তাঁর নির্মলতা ও স্বচ্ছতা ২. ব্যক্তিত্বের উচ্চতা ৩. শিক্ষাদানের প্রভাব ৪. আন্তরিকতা ও দুনিয়াবিমুখতা ৫. উলামায়ে দেওবন্দের বাস্তব নমুনা হয়ে ওঠা

শিক্ষার্থীরা জানে—তিনি যেসব বিষয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন, তা দলিলভিত্তিক, ইনসাফপূর্ণ এবং উম্মাহর বৃহৎ কল্যাণ চিন্তা থেকে উৎসারিত। এই জন্যই কোনো ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে কলম ধরতে পারেনি।

মতভিন্নতা ও সহনশীলতার বাস্তব অনুশীলন

তিনি ছাত্রদের স্পষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন—মতবিরোধ কখনো বেয়াদবিতে রূপ নিতে পারে না। শাইখুল ইসলাম হাফিজাহুল্লাহ মতবিরোধে ইলমী আলোচনা এবং দালিলিক বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দেন। তিনি শেখান: কিভাবে ইখতেলাফে আদাব বজায় রাখতে হয় ? কিভাবে অন্য মতকে শ্রদ্ধা করতে হয় ? কিভাবে বিভ্রান্তি ও গীবত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয় ? এই চিন্তা তাঁর ছাত্রদের অন্তরে নৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে।

উম্মাহর জন্য তাঁর চিন্তা ও আন্দোলন

শাইখুল ইসলাম ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ কেবল একজন শিক্ষক নন—তিনি একজন চিন্তাবিদ নেতা। তাঁর দাওয়াতি কর্মকাণ্ডে রয়েছে: মাযহাব ও মানহাজ ভিত্তিক ওয়াহদাতের আহ্বান। সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান। ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আধুনিক চিন্তার সংযোজন। তরুণদের চিন্তা-বিকাশে প্রশিক্ষণ ভিত্তিক দিকনির্দেশনা।

সমসাময়িক ইসলামী নেতৃত্বে অবদান

তিনি বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে শান্তিপূর্ণ ইসলামী আন্দোলনের বহু সংগঠন। তাঁর দাওয়াতি ভাষা দৃষ্টিভঙ্গি পরিপক্ব ও সৌম্য। ইসলামি রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিটি পরিসরে তাঁর প্রভাব দৃশ্যমান। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ এমন একজন আলেম, যিনি সময়কে জয় করেছেন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আন্তরিকতা দিয়ে। তাঁর ছাত্রদের হৃদয়ে তিনি চেতনার বাতিঘর, নেতৃত্বের মানদণ্ড, আদর্শের প্রতীক হয়ে আছেন। তাঁকে উপেক্ষা করা নয়, তাঁকে উপলব্ধি করাই সময়ের দাবি।

আল্লাহ তাঁকে হিফাযত করুন, পূর্ণ সুস্থতা দিন, তাঁর জীবনী ও চিন্তা আমাদের জন্য হিদায়াতের মশাল হয়ে থাকুক। আমিন।

লেখক: প্রিন্সিপাল, চরকিশোরগঞ্জ মদীনাতুল উলুম মাদরাসা, নারায়ণগঞ্জ ; খতীব, গণপূর্ত কমপ্লেক্স জামে মসজিদ, মুন্সীগঞ্জ

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment