Home শিল্প সাহিত্যসিরাত সংখ্যা। মদিনা শরীফে এক বছর: হৃদয়ের শহর, আত্মার আশ্রয়

সিরাত সংখ্যা। মদিনা শরীফে এক বছর: হৃদয়ের শহর, আত্মার আশ্রয়

by .
সিরাত সংখ্যা। মদিনা শরীফে এক বছর: হৃদয়ের শহর, আত্মার আশ্রয়

মাওলানা আরিফুল হক

জীবনের বহু প্রার্থনা, অশ্রু, রাতের গভীরতা আর ফজরের দোয়াকে আল্লাহ কবুল করেছিলেন এক অনুপম রূপে—যখন কর্মের প্রয়োজনে আমি মদিনা শরীফে এক বছর অবস্থান করার সৌভাগ্য লাভ করি। আজ আমি সৌদি আরবের অন্য শহরে থাকলেও মদিনার মাটির ঘ্রাণ এখনও আমার দেহে লেগে আছে, তার বাতাস এখনও আমার শ্বাসে বেঁচে আছে। এই শহরের প্রতিটি সকাল, প্রতিটি সন্ধ্যা যেন হৃদয়ের এক স্থায়ী স্মৃতি।

মসজিদে নববী ও রওজা মুবারক

মসজিদে নববী, নবীজির প্রিয় স্থান, যেখানে তিনি সাহাবীদের নিয়ে বসতেন, শিক্ষাদান করতেন, দোয়া করতেন—সেই ময়দানে পা রেখে মনে হচ্ছিল, সময় থমকে গেছে। আমার ডানপাশে কেউ হয়তো আবু বকর (রাঃ), বাম পাশে উমর (রাঃ) বসে আছেন এমন অনুভূতি হচ্ছিল। প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি দেয়াল যেন কোনো না কোনো কাহিনির সাক্ষী। যেদিন প্রথমবার মসজিদে নববীতে প্রবেশ করি, বুকের ভেতর কাঁপছিল। চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল আপনাআপনি। সবুজ গম্বুজ চোখে পড়তেই যেন দুনিয়ার সমস্ত শব্দ থেমে গেল, চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে শুধু হৃদয়ের কান্না শোনা যাচ্ছিল। রওজা মুবারকের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়ার মুহূর্তটা ভাষাহীন। যে মানুষটির জন্য আসমান-জমিন সৃষ্টি, যার উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকা ঠোঁটে দুরুদ—এই অনুভব কোনো কলমে আঁকা যায় না। বারবার মনে হতো—‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি এসেছি, খুব দূর পথ পেরিয়ে, অনেক পাপ পেছনে ফেলে… আপনি দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমায় ক্ষমা করে দেন।’

রিয়াদুল জান্নায় সিজদা দিয়ে কেঁদেছি, বহুবার কল্পনায় নবীজির(সা.)পায়ের কাছে নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখেছি। যে সিজদাগুলো মদিনায় করেছি, সেগুলোর অনুভব ছিল সব সিজদার চেয়ে আলাদা—অনেক বেশি নরম, অনেক বেশি কান্নাভেজা।

উহুদ পাহাড়: শহীদদের ভূমি, ভালোবাসার পাহাড়

নবীজি (সা.) একবার বলেছিলেন, “উহুদ আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদকে ভালোবাসি।” সেই ভালোবাসা আমি অনুভব করেছি নিজ চোখে উহুদ পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে। পাহাড়টির সামনে দাঁড়িয়ে যেন ফিরে যাওয়া যায় ১৪০০ বছরের পেছনে। কোথাও ধুলোমলিন এক বাঁকেই হয়তো হযরত হামযা (রাঃ) শহীদ হয়েছেন, কোথাও নবীজি (সা.) এর দাঁত রক্তাক্ত হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, বাতাসে এখনও সাহাবাদের তাকবীর ধ্বনি ভেসে আসে। শহীদদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আমার হৃদয়ে তীব্র আবেগ খেলে গিয়েছিল—এই তো সেই মানুষরা, যারা নিজের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন আমাদের ঈমান বাঁচিয়ে রাখতে।

কুবা মসজিদ: ইসলামের প্রথম ভালোবাসা

কুবা মসজিদে গিয়ে মনে হয়েছিল, এ যেন এক সরলতা আর বরকতের প্রতীক। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে এ মসজিদ গড়েছেন, প্রতি শনিবার সেখানে নামাজ আদায় করতেন। আমি বহুবার কুবা মসজিদে গিয়েছি। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, এই জায়গাটায় দাঁড়ানো মানেই নবীজির (সা.) স্পর্শ পাওয়া, তাঁর কদমের ধুলায় মাথা রাখা। যে শান্তি কুবায় দুই রাকাত নামাজে পেয়েছি, তা অনেক দীর্ঘ ইবাদতেও কখনো পাইনি।

জন্নাতুল বাকি: নিঃশব্দ ইতিহাসের শহর

মদিনায় অবস্থানের সময় আমি বহুবার গেছি জান্নাতুল বাকি’তে। এটি কোনো সাধারণ কবরস্থান নয়—এ যেন ইসলামি ইতিহাসের হৃদপিণ্ড। সেখানে শুয়ে আছেন সাহাবায়ে কেরাম, উম্মুল মুমিনীনগণ, নবীজির সন্তান ও আত্মীয়স্বজন। আমি বাকি কবরস্থানে ঢুকে কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকতাম। যেন বাতাসও সেখানে ধীরে বইছে। মৃতরা যেন নিদ্রারত নয়, বরং চোখ বন্ধ করে ধ্যান করছেন। মনের ভেতর দোয়ার ঢেউ জেগে উঠত—”হে আল্লাহ! এখানেই আমার কবর হোক, নবীজির (সা.) পাশে, সাহাবাদের আশেপাশে।” শেষ কথাঃ এক বছর ধরে মদিনায় ছিলাম, কিন্তু সেই সময়টুকু যেন জান্নাতের একটা ঝলক ছিল দুনিয়ার বুকে। এখন অন্য শহরে থাকলেও, মদিনার বাতাস প্রতিদিন বুকের মধ্যে বাজে। এই শহর আমাকে বদলে দিয়েছে। মদিনা আমাকে শিখিয়েছে কাঁদতে, ভালোবাসতে, বিনয়ী হতে। যারা এখনো মদিনার যিয়ারত করতে পারেননি, তাদের জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে দোয়া করি—আল্লাহ আপনাকেও এই শহরের অতিথি করুন। আর যারা মদিনা দেখেছেন, তারা যেন এই ভালোবাসাকে ধরে রাখেন মৃত্যুর পরও, কবর পর্যন্ত।

লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী , জামিআ ইকরা বাংলাদেশ ; মদিনা প্রবাসী

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment