Home শিল্প সাহিত্যসিরাতসংখ্যা। জ্যোতির্ময় দীপশিখা

সিরাতসংখ্যা। জ্যোতির্ময় দীপশিখা

by .
জ্যোতির্ময় দীপশিখা

মূল | হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারি মুহাম্মদ তাইয়িব রহ.

তরজমা | মুহাম্মাদ হাসিবুল হাসান

মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন—“হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর পথে আহ্বানকারী এবং এক আলোকোজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে।” (সূরা আহযাব, আয়াত ৪৫–৪৬)

এখানে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে— “সিরাজাম মুনিরা”, অর্থাৎ এক জ্যোতির্ময় প্রদীপ। তিনি এমন এক আলো, যিনি সত্য ও অসত্যের সীমারেখা স্পষ্ট করে দেন, পথহারা মানুষকে সঠিক পথে আহ্বান জানান এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়কে আলোকিত করেন।

বিশ্বজগতের অন্ধকার দূর করতে যেমন একটি সূর্য রয়েছে, তেমনি মানবজীবনের অন্তর ও আত্মাকে আলোকিত করার জন্যও রয়েছে আরেকটি সূর্য—তিনি হলেন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

প্রকৃতির সূর্য উদিত হয় ফজরের পর, কিন্তু এই আত্মিক সূর্য উদিত হয়েছেন অজ্ঞানতার ঘন আঁধার ভেদ করে—যখন পৃথিবী ডুবে ছিল অবিচার, জুলুম আর অমানবিকতার গভীর রাত্রিতে। তিনি তখন এসেছেন আলো হয়ে, পথপ্রদর্শক হয়ে, মুক্তির দিশা দেখিয়ে।

“সিরাজাম মুনিরা”—মাত্র দশ অক্ষরের একটি শব্দগুচ্ছ। অথচ এর ভেতরে যে অর্থের বিপুল ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে, তা সত্যিই অভিভূত করার মতো। এ যেন এক সমুদ্র, যার গভীরতা অনাবিষ্কৃত। এতে নবীজীর সীরাতের এমন মহিমা ও তাৎপর্য সঞ্চিত আছে, যা শত শত খণ্ডে রচিত গ্রন্থ দিয়েও পূর্ণরূপে ব্যক্ত করা যায় না।

এই একটিমাত্র শব্দে ধরা দিয়েছে শুধু তাঁর জীবনের ঘটনাপ্রবাহই নয়, বরং তাঁর অনন্য গৌরব, অতুলনীয় মর্যাদা এবং অতীতের সকল নবী-রাসুলের তুলনায় তাঁর মহত্তম স্থানও প্রতিফলিত হয়েছে।

কিন্তু কেউ যদি সরল মনে বলে বসেন—“এই শব্দে তো তেমন কিছু বোঝা গেল না! এটি কি তবে কেবল অলংকারের চাতুরী নয়?”

তাদের বোঝা উচিত—কুরআন কোনো কবিতার সংকলন নয়, কুরআন হলো চিরসত্যের দীপ্তধারা। এখানে এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে কল্পনার মোহ বা অলংকারের খেলা এসে সত্যকে আড়াল করবে।

কুরআন নিজেই ঘোষণা করেছে—“এটি কোনো কবির কথা নয়।” অর্থাৎ, এর প্রতিটি শব্দই সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত, ওহির মাধুর্যে পরিপূর্ণ এবং গভীরতম অর্থবহ—শব্দে-শব্দে চিরন্তন বাস্তবতার প্রতিধ্বনি।

আসলে “সিরাজাম মুনিরা”—এই উপমাটি কুরআনের সেই অনন্য শৈলীর দৃষ্টান্ত, যেখানে কোনো ঘটনা বা গুণাবলি আলাদা করে তালিকাভুক্ত করা হয় না; বরং এক উপমা, এক প্রতীক, এক জীবন্ত চিত্রের মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ করা হয়, যা সরাসরি হৃদয়ে দাগ কাটে।

এ উপমা শুধু বর্ণনা নয়, এ এক দিশারী— যা আমাদের অন্তর ও দৃষ্টি উন্মুক্ত করে, নবুয়তের প্রকৃত রূপটি দেখতে, অনুভব করতে এবং উপলব্ধি করতে শেখায়।

আল্লাহর প্রিয় নবীর সীরাত এমন এক অসীম মহাসমুদ্র, যার গভীরতা কেবল বর্ণনার জালে ধরা দেয় না; তাকে স্পর্শ করতে হয় হৃদয়ের অন্তঃস্থলে, উপলব্ধির নির্মল আলোয়, ঈমান ও প্রেমের মধুর ব্যাকুলতায়।

ভাবুন তো—একটি শিশু যদি যৌবনের অনুভূতি জানতে চায়, আপনি যত ভাষায় তাকে বোঝান না কেন, সে তা অনুধাবন করতে পারবে না; কারণ, সে নিজে সেই অবস্থার স্বাদ পায়নি। একজন তরুণ বৃদ্ধ বয়সের বিষাদ ও শান্তি বুঝতে পারে না; সুস্থ মানুষ মৃত্যুশয্যার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে অক্ষম; জীবিত ব্যক্তি কবরে জীবনের কথা শুধু শুনে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তা অনুভব করতে পারে না।

ঠিক তেমনই, নবুওয়তের সৌন্দর্য, সীরাতের গভীরতা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্রের নূর—এসব কেবল শ্রবণে ধরা পড়ে না। এগুলো উপলব্ধি করতে লাগে হৃদয়ের ঈমানি দৃষ্টি, প্রেমময় অন্তর্দৃষ্টি এবং কুরআনের বাণীতে ডুবে থাকার নীরব সাধনা।

এ কারণেই কুরআন রাসুলের জীবনকে ঘটনাপুঞ্জে সাজিয়ে দেয়নি। বরং এক প্রতীকধর্মী, রূপক ও আলোকোজ্জ্বল চিত্রের মাধ্যমে তাঁর মহিমা অঙ্কন করেছে। “সিরাজাম মুনিরা”—এই ক্ষুদ্র অথচ গভীর শব্দে নবুয়তের সূর্যকে কুরআন চিরকাল দীপ্তিময় করে তুলেছে।

(হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারি মুহাম্মদ তাইয়িব রহ. রচিত ‘আফতাবে নবুওয়ত’ গ্রন্থ অবলম্বনে)

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment