মুফতি সালমান আহমাদ
বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহ বৈশ্বিক যে ষড়যন্ত্রের শিকার তা অতীতে আর কখনো হয়নি। আপনি বিষয়টি যত গভীরভাবে চিন্তা করবেন এবং বুঝবেন ততই গা শিউরে উঠবে এর ভয়াবহতা অনুভব করে।
আল্লাহ পাক রাসূল সাঃ কে মানবজাতির সামনে এভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, لقد كان لكم في رسول الله اسوة حسنة নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ ( সূরা আহযাব-২১)
উক্ত আয়াতের আলোকে রাসূল সাঃ এর পুরো জীবনটাই আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। এখন সমস্যা হচ্ছে, আমরা রাসূল সাঃ কে তাঁর পূর্ণ জীবনে নবী হিসেবে মানি কিন্তু স্বামী হিসেবে মানি না, নবীকে কখনো শিক্ষক হিসেবে মানিনা, কখনো একজন ব্যবসায়ী হিসেবে মানি না, একজন রাস্ট্রনায়ক হিসেবে মানতে পারি না। অথচ প্রিয় নবী সাঃ যেন আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট হিসেবে মিলে যায় সেজন্য আল্লাহ পাক বলেছেন “উসওয়াতুন হাসানা”।
রাসূল সাঃ তাঁর পূর্ণ জীবনে একজন শিক্ষক ছিলেন, একজন সেনাপ্রধান ছিলেন,একজন রাস্ট্রনায়ক ছিলেন,একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।মোটকথা প্রত্যেক ক্ষেত্রে একজন সফল ব্যক্তি ছিলেন তাই আমাদের প্রত্যেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা দরকার।
এবার আসুন দেখি, মুসলিম উম্মাহকে রাসূল সাঃ কিভাবে গঠন করেছেন? এই মুসলিম জাতি ইসলাম আসার আগে ছিল বর্বর জাতি, নিকৃষ্ট জাতি। হযরত দাহইয়া কালবির মতো ব্যক্তি যিনি নিজের মেয়েকে জীবন্ত দাফন করেছেন, ওয়াহশী যিনি নবীজীর চাচা হযরত হামজা রাঃ কে হত্যা করেছেন। অথচ এই মানুষগুলো এক সময় শ্রেষ্ঠ হয়ে গেলেন কিন্তু কিভাবে? তাঁদের জন্য কি আল্লাহ পাক আসমান থেকে ঈমানের দাওয়াত সরাসরি পাঠিয়েছেন নাকি অন্য কোন মাধ্যম রেখেছেন?
আরো একটি বিষয় এখানে বুঝতে হবে,পৃথিবীতে একমাত্র জাতি হচ্ছে মুসলমান যাদের গঠন হয়েছে শিক্ষার মাধ্যমে,অন্য কোন মাধ্যমে না। আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে ৫টি আয়াত নাযিল করলেন সেই পাঁচটি আয়াতই শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়। আমরা যখন কোন অমুসলিম; হিন্দু বৌদ্ধ কাফের মুশরিককে দাওয়াত দিতে যাই তখন আগে বলি তুমি মুসলমান হও,ঈমান আনো। ঐদিকে আবু বকর কাফের তাকে ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে,ওমর কাফের তাকে মুসলিম বানাতে হবে সে ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক সরাসরি ঈমান আনার কথা না বলে আল কুরআনের প্রথম ৫টি আয়াত অবতীর্ণ করলেন শিক্ষা সংক্রান্ত ।
১ নম্বর) “ইক্বরা” পড়ুন। মানে পড়া ছাড়া জাতি গঠনের বিকল্প নেই। এটা হচ্ছে শিক্ষার দর্শন।
২) বিসমি রব্বিকাল্লাযি খালাক” ঐ রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। এই হচ্ছে কারিকুলাম, শিক্ষা সিলেবাস। পুরো পৃথিবীর সংঘর্ষ এখানে আর কোথাও সংঘর্ষ নেই। মনে রাখবেন,এটা হচ্ছে রবের পরিচয়ওয়ালা জ্ঞান।
৩) খালাক্বাল ইনসানা মিন আলাক” এই আয়াতে আল্লাহ পাক শিক্ষার ধরণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। জাগতিক বিদ্যা নয় বরং জাগতিক দক্ষতা। ডাক্তার হওয়া দক্ষতা,ইন্জিনিয়ার হওয়া দক্ষতা,বিজ্ঞানী হওয়া দক্ষতা দক্ষতা ভিন্ন জিনিস জ্ঞানী হওয়া ভিন্ন জিনিস। ইসলামি জ্ঞান দ্বারা জ্ঞানী হওয়া যায় আর জাগতিক বস্তু দ্বারা দক্ষ হওয়া যায়।
৪) আল্লামা বিল ক্বলাম” শিক্ষা উপকরণ নিয়ে আলোচনা করলেন।
৫) “আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম” পঞ্চম নম্বর আয়াতে শিক্ষার ফজিলত নিয়ে আলোচনা করলেন।
এখন আপনার কাছে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথম ৫টি আয়াতের সবগুলো শিক্ষা সংক্রান্ত হল কেন? সহজ উত্তর হচ্ছে, একটা বর্বর জাতি তৈরি হবে,অনুত্তম জাতি থেকে উত্তম জাতি তৈরী হবে,মন্দ জাতি থেকে উৎকৃষ্ট জাতি তৈরি হবে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমে। কোন শিক্ষা? যে শিক্ষার মধ্যে রবের পরিচয় আছে।
বর্তমান ন্যাশনাল কারিকুলাম বলেন অথবা ইন্টারন্যাশনাল কারিকুলাম এখানে সবকিছুর পরিচয় আছে শুধু নেই রবের পরিচয়। বর্তমান যুগের মূল লড়াইটা এখানেই। রবের পরিচয়হীন শিক্ষা দ্বারা একটা আদর্শ জাতি তৈরি হতে পারে না। হযরত দাহইয়া কালবি রাঃ অনেক বড় ব্যক্তি ছিলেন তাকে তৈরী করতে আসমান থেকে কোন মেশিন পাঠানো হয়নি বরং একটি কারিকুলাম তৈরী করা হয়েছে। হযরত ওমর রাঃ রুক্ষ মেজাজের মানুষ ছিলেন তাকে আদর্শ ব্যক্তি বানাতে হবে। আসমান থেকে কারিকুলাম তৈরী করে পাঠানো হয়েছে। তৎকালে জাগতিক শিক্ষা ছিল না? ছিল।
দেখেন মিস্টার আবু জাহেল তার আগের নাম ছিল আবুল হিকাম জ্ঞানীর পিতা বা বুদ্ধিজীবী। এই ব্যক্তিটা ৪টি ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ছিল। ১) সফল আবহাওয়াবিদ ছিল। বালু হাতে নিয়ে ছেড়ে দিত।এবং তার গতি দেখে বলে দিত আজকে বৃষ্টি হবে কি হবে না। ২) সফল কৃষিবিদ ছিল।খেজুর বাগানে গিয়ে খেজুরের বিচি দেখে বলত,এই গাছে পানি দাও ঐ গাছটা ছেঁটে দাও ইত্যাদি। অর্থাৎ ৩) পশুবিদ ছিল, উটনীর পায়খানা দেখে বলে দিত এর পেটের বাচ্চাটা কোন অবস্থায় আছে,উট প্রসব করবে নাকি উটনী। ৪) ইলমুল কিয়াফা তথা পায়ের ছাপ দেখে বলে দিত কোন গোত্রের লোক,ছেলের পা নাকি বাবার পা।
সম্মান লাভের ৪টি উপকরণ ১. নেতৃত্ব ২. শিক্ষা ৩. বংশ মর্যাদা ৪. সৌন্দর্য। যার কাছে এত যোগ্যতা সে মূল্যহীন আর হযরত বেলাল হাবশি রাঃ এর কাছে কোন ডিগ্রি নেই অথচ তিনি দামী হলেন কিভাবে? কারণ হচ্ছে, হযরত বেলাল রাঃ এর নিকট রবের পরিচয়ওয়ালা শিক্ষা ছিল জাগতিক অল্প থাকলেও তিনি উৎকৃষ্ট হয়ে গেছেন আর আবু জাহেলের কাছে জাগতিক সব কিছু শতভাগ থাকার পরও রবের পরিচয় না থাকায় সে নিকৃষ্ট হয়ে গেছে। তার মানে রবের পরিচয় হল ১ এর মতো আর জাগতিক শিক্ষা হল ০ এর মতো। ১ এর পরে যত শূন্য বসবে সংখ্যা বাড়তেই থাকবে আর জিরোর পরে আপনি জিরো যতই বসান জিরো বাড়তেই থাকবে কাজের কাজ শূন্যই থেকে যাবে।
এখন মুসলিম জাতি যদি রবের পরিচয়ওয়ালা সিলেবাস কারিকুলাম বাদ দেয় তাহলে তারা আবার সেই বর্বর জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
আজ আন্তর্জাতিকভাবে চক্রান্তটা কোথায় হচ্ছে এটা আপনাকে বুঝতে হবে। ওরা চাচ্ছে আমরা যেন বেলালের উত্তরসূরী না হয়ে আবু জাহেলের উত্তরসূরী হই। এ জন্য তারা সিলেবাস থেকে রবের পরিচয় মুছে বস্তুকেন্দ্রীক বিষয় ঢুকিয়ে দিয়েছে কারণ আবু জাহেলের উত্তরসূরী হলে একে ধ্বংস করা লাগবে না এমনিতেই সে ধ্বংস হয়ে যাবে।
হযরত ওমর রাঃ কে-ই দেখুন, ইসলাম গ্রহণের আগে মাত্র ২০টা বকরী চরাতে সক্ষম হননি,মেজাজ বিগড়ে একটাকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলেছেন বাকিগুলো ভয়ে পালিয়ে গেছে। ব্যবসা করতে সিরিয়া গিয়েছেন সেখানে কাস্টমারকে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিয়েছেন সফল হননি। সেই মানুষটাই সফলভাবে অর্ধ জাহান শাসন করে গেছেন। এ জন্য ইন্ধিরা গান্ধী বলেছে, পৃথিবীতে শান্তি আনতে গেলে ২য় ওমর লাগবে, নইলে সম্ভব না। যে ওমর আগে হিংস্র ছিল এখন আদর্শবান হল কিসের মাধ্যমে? রবের পরিচয় ওয়ালা ইলমের মাধ্যমে। অতএব যদি মুসলিম জাতির রক্ষা পেতে হয়,আদর্শ জাতি হতে হয় তাহলে এই রবের পরিচয় ওয়ালা সিলেবাসে ফিরে আসতে হবে নইলে এ জাতির রক্ষা নেই।
মনে রাখবেন, যে জাতি গঠিত হয় শিক্ষা কারিকুলাম ভিত্তিক সে জাতি ধ্বংসও হবে শিক্ষা কারিকুলাম ভিত্তিক। এ জন্য পলিসি করেই আমাদের ধ্বংস করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ৫ কোটি শিক্ষার্থী আছে এর মাঝে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানে যায় ২কোটি ৬১ লক্ষ শিক্ষার্থী আর বেসরকারিতে যায় ২ কোটি ৩৯ লক্ষ শিক্ষার্থী। দৈনিক এদেরকে নাস্তিক্যবাদ কেন শেখানো হচ্ছে? ধর্মবিদ্বেষ কেন দেওয়া হচ্ছে? একটু চিন্তা করে দেখেন আমরা কোথায় আছি?
বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের ধ্বংস করার জন্য ভিশন থার্টি প্রকল্প, এম.ডি.পি প্রকল্প এসব হাতে নিয়ে মুসলমানদের কারিকুলাম ভিত্তিক ধ্বংস করা হচ্ছে। আলবেনিয়া যেখানে নাসিরুদ্দিন আলবানির মতো ব্যক্তি তৈরী হয়েছে অথচ সেখানে ৬৫ বছর পর্যন্ত ইসলামধর্ম পালন নিষিদ্ধ ছিল। এটা পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ৫২%মুসলিম থাকার পরও তারা নাস্তিক। সেখানে কুরআন শরীফ পড়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদান সবগুলো দেশের ইতিহাস জানুন তারা আগে শতভাগ মুসলিম দেশ ছিল কিন্তু শিক্ষা কারিকুলামের মাধ্যমে পুরো দেশকেই খৃষ্টান রাস্ট্র বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
এখন আমাদের বাঁচতে হলে,ঈমান টিকাতে হলে আবারও ধর্মীয় শিক্ষার কাছে ফেরত আসতে হবে। আশির দশকে বাংলাদেশে জরিপ করা হয়েছে, সরাসরি দ্বীন শিখত ২০% আর ৬০% দ্বীনকে ভালোবাসত।
২০১৫ সালের জরিপ সরাসরি দ্বীন শিখে ২% আর ভালোবাসে ২০% মাত্র ৩৫ বছরে আনুপাতিক হারে এত কমে গেল কেন? কমার কারণটা কি? ৩টি কারণ ১) মসজিদভিত্তিক মক্তব বন্ধ হয়ে যাওয়া ২)উলামায়ে কেরামের সোহবত থেকে বঞ্চিত হওয়া। ৩) ন্যাশনাল কারিকুলাম থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেওয়া। প্রিয় পাঠক! এবার চিন্তা আপনার, সিদ্ধান্ত আপনার,চুপচাপ বসে থেকে জীবন পার করবেন নাকি আপনার জায়গা থেকে মুসলিম উম্মাহকে বাঁচাতে নড়েচড়ে বসবেন। রাসূল সাঃ এর সিরাতের আলোকে আমাদের জাগতে হবে উম্মতকে জাগাতে হবে,বাংলার আনাচে-কানাচে মক্তব শিক্ষা ব্যপক করতে হবে।
আল্লাহ পাক আমাদের জন্য সবকিছু সহজ করে দিন।
লেখকঃ মুফতি সালমান আহমাদ, সদর,দ্বীনিয়াত বাংলাদেশ
শ্রুতিলিখনঃ মুহাম্মাদ আইয়ুব