Home শিল্প সাহিত্যসিরাতসংখ্যা । মক্কা-মদীনায় যাওয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য

সিরাতসংখ্যা । মক্কা-মদীনায় যাওয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য

by .
siraat-16

মুফতি মুহিব্বুল হক

بسم الله الرحمن الرحيم، الحمد لله وحده
والصلاةوالسلام على من لا نبي بعده، اما بعد فاعوذ بالله من الشيطان الرجيم .
بسم الله الرحمن الرحيم. وما محمد الا رسول قد دخلت من قبله الرسل( سورة ال عمران)

এই নশ্বর পৃথিবীর সৃষ্টি;চন্দ্র ,সূর্য, গ্রহ ,নক্ষত্র ,ভূমন্ডল নভোমন্ডল, পাহাড়-পর্বত নদ নদী, খাল- বিল, সমুদ্র মহাসমুদ্র, মানব- দানব ,গাছ-পালা, বৃক্ষ তরুলতা জীবজন্তু তথা আল্লাহ তাআলার গোটা বিশ্ব জগতের সৃষ্টি ,এর পিছনে মূলসূত্র ওই মহান সত্তা যাকে কেন্দ্র করেই সবকিছুর আবির্ভাব ,বহিঃপ্রকাশ;তিনি হলেন আকায়ে নামদার তাজদারে মদিনা খাতিমুর রুসুল, সাইয়্যিদুনা ও সাইয়্যিদুল আম্বিয়া, নবীয়ে আরাবি, শান্তির দূত জনাবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)

যার জীবন, মৃত্যু সবই আল্লাহ তাআলার রহমত। তিনি যে পবিত্র মাটিতে শুয়ে আছেন ওই মাটির মূল্য ও সম্মান আল্লাহ তায়ালার গোটা সৃষ্টি অপেক্ষা অত্যন্ত দামি এবং মূল্যবান।
پاکیزہ تراز عرش بریں جنت فردوش

آرام گاہ پاک رسول عربی ہے

এক বুজুর্গ বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশ্রামাগার (কবর মোবারক) কা’বা শরীফ এবং আল্লাহপাকের আরশ ও জান্নাতুল ফেরদাউস থেকে ও অত্যন্ত দামি, পূত পবিত্র। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতদিন পৃথিবীতে অবস্থান করছিলেন তথা বেঁচে ছিলেন তখনও তিনি রহমাতুল্লিল আলামিন ছিলেন ,আবার যখন তিনি পরজগতে পাড়ি জমিয়েছেন তখনও তিনি রহমাতুল্লিল আলামিন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় তাহার জিয়ারত করা (সাক্ষাৎ করা) ছিল যেমন মহা পূণ্যের তেমনিভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্থানান্তরিতার ( ইন্তেকালের) পর তাহার কবর শরীফে জিয়ারতে যাওয়া তেমনি বরকতপূর্ণ ও মহা পূণ্যের ।
স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

-قال رسول الله: – صلى الله عليه وسلم
من زارني كان في جواري يوم القيامة
( البيهقي في شعب الايمان والمشكاة)

“যে ব্যক্তি আমি নবীর জিয়ারতে আসবে সে কেয়ামতের দিন আমার প্রতিবেশী হবে”

وقال عليه الصلاة والسلام -من حج فزار قبري بعد موتي كان كمن زارني في حياتي
. (البيهقي في شعب الايمان والمشكاة)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,যে ব্যক্তি হজ করলো অতঃপর আমার কবর জিয়ারত করলো সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাক্ষাৎ করলো”

وقال: عليه الصلاة والسلام -من حج البيت ولم يزرني فقد جفاني،
(رواه ابن علي بسند حسن شرح لباب.)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহর হজ করলো কিন্তু আমার সাক্ষাতে(জিয়ারতে) আসলো না তাহলে সে যেন আমার উপর জুলুম করল (অন্যায় করল)

وقال:- عليه الصلاه والسلام- من زار قبري وجبت له شفاعتي. (رواه دارقطني والبزار و فتح القدير)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করতে আসলো তার জন্য আমার সুপারিশ অবধারিত”

যেহেতু স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরীফে যাওয়ার জন্য উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করেছেন , উৎসাহ যুগিয়েছেন। অন্তরে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মোহাব্বত আন্তরিকতা ভালোবাসা নিয়ে জিয়ারত করা এটাকেও তিনি মহান এবাদত হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

তবে মদিনার জিয়ারত এর অর্থ এটা নয় যা বর্তমানে আমাদের মন মানসিকতায় বিদ্যমান।
আমরা অনেকে মনে করে থাকি মদিনা যাওয়া মানে ওখানকার রাস্তাঘাট, দালানকোঠা ঘরবাড়ি , গাড়ি-ঘোড়া, চাকচিক্যময় মনমাতানো আলো ঝলমলে পরিবেশ। ওখনকার সুস্বাদু খাবার,বিশ্বমানের শপিং ইত্যাদি অথচ এমন কিছু চিন্তা করা বা এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া ভুল বরং মদিনা শরীফে যাওয়ার অর্থই হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা (অর্থাৎ রসুলের প্রতি যে ভালবাসায় আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ ও অনুকরণে বাধ্য করে ,পাগল বানায়) মৃত্যুর পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুপারিশ অর্জন, হাউজে কাউসারের পানি দ্বারা তৃপ্ত হওয়া , মিজানের পাল্লায় ওজনের সময় ও পুলসিরাত পাড়ি দেওয়ার সময়ে সুপারিশ কিভাবে অর্জন করা যায় সেই চিন্তা থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে জান্নাতে থাকার, তাঁর প্রেমে পাগলপারা হওয়ার চিন্তাভাবনা, মুহাব্বাত ভালোবাসা আন্তরিকতা নিয়েই মদিনা শরীফে উপস্থিত হওয়া একান্ত কাম্য যেন আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত সুন্দর হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহর রাসুলের আশেকগণ নির্জনে বসে বসে বিশেষ করে শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজের পর অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও কায়মোনাবাক্যে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে আল্লাহ পাকের শাহী দরবারে দুখানা হাত উত্তোলন করে দোয়া এবং কান্নাকাটি করতে থাকেন।
যার ফলশ্রুতি দেখা যায় যে, আল্লাহর রাসূলের অনেক আশেক এমন আছেন যাদের কাছে না আছে অর্থ, না আছে শক্তি ,না আসে সামর্থ্য; কিন্তু তাদের এই হৃদয় বিগলিত দোয়া ও কান্নাকাটির বদৌলতে আল্লাহ পাক তাদেরকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর মোবারকে উপস্থিতিতে ধন্য করে থাকেন।

ساحل سے لگا دے میرے عشقوں کا سفینہ *
آنکھوں سے دیکھا دے مجھے مکہ و مدینہ
رہے میںرا مسکن حوالی کعبہ *
‌۔ بنے میرا مد فن دیار مدینہ

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমার এশক ও মহব্বতের রণতরিকে সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে চলো। আমার চক্ষুদ্বয় দিয়ে মক্কা-মদিনা দেখিয়ে দাও। আরো দোয়া করেন,হে আল্লাহ! আমার আবাসস্থল যেন কাবা শরীফের আশপাশে হয়, অতঃপর সর্বশেষ আমার দাফনের স্থান যেন মদিনা শরীফ হয়। তবে বাস্তবতা এই যে ,বর্তমানে সময়ে আমরা যে উদ্দেশ্য মনোভাব ও মানসিকতা নিয়ে মদিনাতে যাচ্ছি বা যাওয়া হচ্ছে এর অনেকাংশে মনে হয় সঠিক হচ্ছে না।

কারণ হল,আমাদের মক্কা মুকাররমায় যাওয়া ,মদিনা শরীফে উপস্থিতি সব যেন ভ্রমণ ,পদযাত্রা ,ট্যুর হিসেবে পরিগণিত হয়ে যাচ্ছে! টাকা আছে চলো একটু ভ্রমণ করে আসি, ঘুরে আসি। এ সুযোগে একটু ইনজয় করে আসি।

আজকাল শতভাগ বাস্তব সম্মত কথা হচ্ছে,বর্তমান সৌদি প্রশাসন পৃথিবীজুড়ে অমুসলিমদের কৃষ্টিকালচারে প্রভাবিত হয়ে পবিত্র ভূমিকে ডিজিটাল (আধুনিক করন) চিন্তাভাবনা কলাকৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। তারা বিভিন্ন জাগতিক স্থাপনার মতো পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরীফকে সে আঙ্গিকে বানিয়ে ফেলছে। এটাকে বানিজ্যিক হাব হিসেবে গড়ে তুলছে। তারা মক্কা শরীফ ও মদীনা মুনাওয়ারা সফরের মূল উদ্দেশ্য ও মাকসাদ থেকে মুমিন মুসলমানদেরকে আখেরাত পানে অগ্রসর হওয়া থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে হঠিয়েছে আর এর পরিণতি যে কি হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।

তাই আজকাল হজ এবং ওমরা করে আসার পরেও আমাদের জীবনের নৈতিক কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না‌। আগে যেমন এবাদত বন্দেগির মধ্যে অমনোযোগিতা ছিল
দ্বীনের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা, জামাতের সাথে নামাজ আদায় রোজা ,হজ ,যাকাত, জিকির তেলাওয়াত ,ইবাদত বন্দেগি আদায়ে আগ্রহী হওয়া ও দ্বীনদার লোকদের প্রতি ( বিশেষত ওলামায়ে কেরামের প্রতি) শ্রদ্ধা ,সম্মানের আগ্রহ উদ্দীপনা আরো বৃদ্ধি হওয়ার ছিল কিন্তু হিতে বিপরীত হচ্ছে সবকিছু। তাছাড়া হজ ওমরা করার পরও দেখা যায় লেনদেন ,জীবন যাপন , বিবাহ শাদী, মুয়ামালা -মুয়াশারা ইত্যাদির মধ্যে ভুল ভ্রান্তিতে ভরা ,আদাব ও আখলাক ইত্যাদির মধ্যে যেমনটা ছিল অশুদ্ধ, সুদ-ঘুষ মিথ্যা-অপবাদ হিংসা বিদ্বেষ ,জুলুম ,অত্যাচার,অন্যায় অপরাধ, দুনিয়ার প্রতি লোভ লালসা, আখেরাতের প্রতি অনীহা ইত্যাদি সবই বিদ্যমান ।

কিন্তু কথা হচ্ছে, পবিত্র ভূমি জিয়ারতের পরও যদি জীবন আগের মতো থেকে যায় তাহলে মদিনা শরীফের জিয়ারতে যে মৌলিক পরিবর্তন হওয়ার ছিল তার কিছুই তো হয় নাই বললে চলে। তাহলে এই জিয়ারতের ফলাফল কি দাড়াতে পারে তা একেবারে দিবালোকের ন্যয় স্পষ্ট । যেটা মূলত কেয়ামতের একটা পূর্বাভাস। অর্থাৎ বর্তমান আমাদের চিন্তা ভাবনা মানসিকতা সম্পূর্ণই বিপরীত। মূল উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । সুতরাং এই চিন্তাভাবনার পরিবর্তন হওয়া একান্ত জরুরি।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মূল মাকসাদকে সামনে রেখে চলার ও আমল করবার তৌফিক দান করুন। আমীন, সুম্মা আমীন।

লেখকঃ শাইখুল হাদিস , ভবানিপুর মাদরাসা , গোপালগঞ্জ

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment