কুৎসা রটানো এমন ভয়াবহ অপরাধ, যা চুরি-ডাকাতি, সুদ-ঘুষ, জিনা-ব্যবিচার এমনকি মৃত মানুষের পচা গোশত খাওয়ার চেয়েও ভয়াবহ ও নিকৃষ্ট। অথচ মানুষ এ সম্পর্কে পরিপূর্ণ গাফেল। চায়ের আড্ডা থেকে আল্লাহর ঘর মসজিদ—সব জায়গাতেই মানুষ হরহামেশা গিবত নামক ভয়ানক অপরাধটি করে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো পরনিন্দার রাস্তাকে আরো সহজ করে দিয়েছে।
গিবতের পরিচয়: হাদিস শরিফে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) গিবতের পরিচয় বলে দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা গিবত কী জানো? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তোমার ভাইয়ের এমন কোনো দোষত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। জিজ্ঞেস করা হলো, আমি যা আলোচনা করেছি, যদি বাস্তবেই তা তার মধ্যে থাকে, তাহলেও কি গিবত হবে? তিনি বললেন, যদি তার মধ্যে তা থেকে থাকে, তবে তুমি গিবত করেছো। আর যদি না থাকে, তবে তো তুমি অপবাদ দিয়েছো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৯)
গিবতের মাধ্যম: মানুষ সাধারণত পাঁচটি বস্তুর মাধ্যমে গিবত করে। সেগুলো হলো : ১. মুখ। এটি গিবতের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। কথাবার্তা, বক্তব্য-বক্তৃতা, আলাপচারিতা প্রভৃতির মাধ্যমে মুখের গিবত হয়। এজন্য জবানের ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিত। অন্যথায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়ে যেতে পারে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিঃসন্দেহে বান্দা কখনো এমন কথা বলে ফেলে, যার পরিণাম সে চিন্তা করে না। অথচ এ কথার মাধ্যমে সে জাহান্নামের এমন গভীর গর্তে নিক্ষিপ্ত হবে, যার দূরত্ব পূর্ব-পশ্চিমের সমপরিমাণ।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৫৭৭)
২. কান। গিবত শ্রবণ করা কানের মাধ্যমে গিবত করার নামান্তর। কারণ গিবত করা এবং তা শ্রবণ করা উভয়টি সমান অপরাধ। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, যখন কেউ আপনার সঙ্গে বসে অন্যের গিবত করে, তখন তাকে থামতে বলুন, গিবতের ব্যাপারে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিন। এতেও যদি কাজ না হয় তবে আপনি সেখান থেকে প্রস্থান করুন। তবু কোনোভাবে গীবত শোনা যাবে না।
৩. অন্তর। কেউ গিবত করলে তা অন্তর দিয়ে মেনে নেওয়া, সমর্থন করা কিংবা আনন্দিত হওয়ার মাধ্যমে অন্তর দ্বারা গিবত করা হয়। মুখে মুখে কারো দোষ চর্চা যেমন হারাম, অনুরূপভাবে অন্তরে কারো ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করাও হারাম।
৪. ইঙ্গিত। কখনো ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমেও গিবত সংঘটিত হয় বলে হাদিস থেকে প্রমাণিত। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) বসেছিলেন। এসময় একজন খাঁটো মহিলা ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে এভাবে ইঙ্গিত করলাম যে, ‘সে বেঁটে মহিলা।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি তার গিবত করে ফেললে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৫৭০৮)
৫. লেখা। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো লেখা। এজন্য গিবত শুধু মুখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ওয়াটসঅ্যাপ, টুইটার প্রভৃতি যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখির মাধ্যমে গিবত হতে পারে।
গিবতের ভয়াবহতা: পবিত্র কোরআন ও হাদিসে গিবত সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে, সেগুলো থেকেই গিবতের ভয়াবহতা অনুমিত হয়। পবিত্র কোরআনে গিবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়াকে পছন্দ করবে? তোমরা তো একে ঘৃণাই করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১২) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ।’ (সুরা হুমাজাহ, আয়াত: ০১) হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) গিবতের অনেকগুলো ভয়াবহ দিক তুলে ধরেছেন। তন্মধ্যে কয়েকটি নি¤œরূপ :
ব্যভিচার থেকে ভয়াবহ: গিবত এমন পাপ যা জিনা-ব্যভিচার থেকেও ভয়ানক। কারণ ব্যভিচারের পাপ তওবা দ্বারা মাফ হয়ে যায়। কিন্তু যার গিবত করা হয়েছে, সে ক্ষমা না করা পর্যন্ত গিবতকারীর ক্ষমা নেই। হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘গিবত ব্যভিচার থেকেও মারাত্মক। কেননা যার গিবত করা হয়েছে, সে যখন ক্ষমা করবে, গিবতকারীর তওবা তখনই কবুল হবে।’ (মুজামুল আওসাত, হাদিস: ৬৫৯০)
ইমান ধ্বংসকারী: গিবত এমন গুনাহ যা ইমানকেও ধ্বংস করে দেয়। হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘গিবত ও চোগলখোরী ইমান ধ্বংস করে দেয়, যেমন রাখাল গাছের ডালপালা কেটে ফেলে।’ (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস: ২২৪৮)
গিবতকারী লাঞ্ছিত: যে অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ করে, আল্লাহ তায়ালা তার দোষত্রুটি মানুষের সামনে নিয়ে এসে তাকে লাঞ্ছিত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুসলমানদের গিবত করবে না এবং দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াবে না। কারণ যে ব্যক্তি তাদের দোষ খুঁজবে, আল্লাহ তার দোষ ধরবেন। আর আল্লাহ যার দোষ ধরবেন, তাকে তার ঘরের ভেতরেই লাঞ্ছিত করবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৮০)
গিবতের শাস্তি: গিবত বা কুৎসা রটানোর পরকালিন শাস্তি ভয়ানক। হজরত হাসান ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত মেরাজের হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমাকে নিয়ে যাওয়া হলে আমি এমন এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে গেলাম, যাদের নখ ছিল তামার। তারা নিজেদের মুখম-ল ও দেহের মাংসে আঁচড় কাটছিল। আমি জিবরাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা নিজেদের ভাইয়ের গিবত করত এবং ইজ্জতহানি করত।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৭৮)