আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ
ঢাকার যানজটকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বাহারি দৃশ্য দেখতে দেখতে যখন বিমানবন্দরের সামনে এসে নামলাম তখন আসরের সময় হয়ে গেছে। ট্রেনে ওঠার আগে নামাজটা পড়ে নেয়া দরকার। বাবুস সালাম মসজিদের সিঁড়িতে পা রাখতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বিশ বাইশ বছরের তিনটা তরুণ সিঁড়ির উপরে নোংরা একটা জায়গায় শুয়ে আছে। প্রায় অবচেতন পড়ে আছে, আবার দুইয়েকটা কথাও বলছে।
দেখেই বুঝা যায়, প্রচণ্ড ব্যস্ত চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা অন্য এক জগতে বাস করে। এভাবেই পথে ঘাটে পড়ে থেকে থেকে ওদের দিনগুলো রাতের আঁধারে ঢেকে যায়। প্রচণ্ড ব্যস্ত এই শহরে কেউ কারো দিকে তাকায় না।
মসজিদের অজু খানায় প্রবেশ করে দেখলাম, টিনেজ বয়সী দুইজন ছাত্র কথা বলতে বলতে তিনতলা থেকে নেমে আসলো। উপরে মাদরাসা। একজনের হাতে লুঙ্গি। আরেকজনের হাতে খানা ওঠানোর বালতি। অজুখানায় কয়েকজন অজু করছে। তারই মাঝে একটা টেপের সামনে বসে ওদের একজন নিঃসংকোচে গোসল করতে শুরু করলো। পাশে অজু করতে থাকা মুসল্লি দ্রুত অজু শেষ করে সটকে পড়লো। সেদিকে ওর ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হলো না।
এখানেও আরো অনেক অবহেলার গল্প লুকিয়ে আছে। নানা অব্যবস্থাপনার ভীড়ে আমাদের ছেলেরা অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ চক্ষু লজ্জাও হারিয়ে ফেলছে।
নামাজ পড়ে প্লাটফর্মে ঢুকতেই মনে হলো, আরেক জগতে এসে পড়েছি। এখানে কত কত বিচিত্র পেশার মানুষ। কয়েকজন চট্টগ্রামে সমুদ্র দেখতে যাচ্ছে। কেউ দাঁড়িয়ে বসে বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। সবাই খুব অসহিষ্ণুভাবে হাঁটাচলা করছে। কারো প্রতি কারো কেয়ার নেই। বেশির ভাগই বৃহত্তর ময়মনসিংহের যাত্রী।
একজন বোরকা পরা মহিলা হাঁটতে হাঁটতে এসে রেললাইনের উপরে বসলো। বসতে বসতে সে বোরকা খুলতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার কৌতুহল দূর হলো। বোরকাকে সে মূলত ভিক্ষার ইউনিফর্ম হিসাবে ব্যবহার করে। এখানে স্টেশনের খোলা জায়গায় বোরকা খুলে একটু আরাম করতে এসেছে। হয়ত একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার নতুন কোনো ট্রেনে গিয়ে উঠবে।
একটু পরে কমিউটার এসে থামলো। ট্রেনের ভেতর বাহির সবজায়গায় মানুষ গিজগিজ করছে। ট্রেনের ছাদেও প্রচণ্ড ভীড়। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, কেউবা আবার শুয়ে আছে। একেবারে সামনের বগির মাথায় দাঁড়িয়ে একটা ছেলে নৌকা বাইচের ভাইরাল ছেলেটার মতো অঙ্গভঙ্গি করছে।
দুই বগির জোড়ার চিপা থেকে তিনটা টোকাই ছেলে বের হয়ে আসলো। একেবারে পেছনের বগির পেছনে দুইটা শিশু ঝুলে আছে। বয়স কত আর হবে? বেশি হলে আট বা নয় বছর। তার বয়সী ছেলেরা যেখানে একা একা গাড়িতে উঠতে ভয় পায় সেখানে সে ট্রেনের পেছনে ঝুলে আছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে কাকে যেন আবার হাত নেড়ে টাটা দিলো। মুখে তার হাসি। এ যেন বৈষম্যভরা সমাজে নিজের মতো বেঁচে ওঠার তৃপ্তি ও একইসাথে সমাজের প্রতি অবজ্ঞার হাসি।
কত অদ্ভুত আমাদের সমাজ। কত বিচিত্রভাবে মানুষ এখানে বেঁচে থাকে তা দেখতে পারা যায় রেলওয়ে স্টেশনে আসলে।
বিমানবন্দর এলাকাটাকে বলা যায়, মিনি বাংলাদেশ। এখানে একপাশে ভিআইপিদের ওড়াউড়ি, আরেক দিকে শ্রমজীবি, পেশাজীবি ও বাস্তুহারা মানুষের গিজগিজে নাড়াচাড়া।
আমি এসব দেখতে থাকি। যমুনা এক্সপ্রেস আসে। আমি ট্রেনে উঠি। এখানেও হাজারও দৃশ্য। এমন এমন জীবনের দৃশ্য যা শুধু এখানেই দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর আর কোথাও এই দৃশ্য দেখা যায় না। এত এত সমস্যা এখানের জীবনগুলোতে জড়াজড়ি করে আছে যা সমাধান অযোগ্য।
তবু হাজারও সমস্যার ভীড় ঠেলেই এখানে জীবন এগিয়ে যায়। ঠিক যেভাবে সরু দুটি লাইনের উপর দিয়ে বিশাল দৈত্যাকার ট্রেনগাড়িটা ঝকঝকাঝক বাজনা বাজিয়ে এগিয়ে যায়।