Home ভ্রমণভ্রমণগদ্য । তাবলীগে চল্লিশদিন ( চতুর্থ পর্ব)

ভ্রমণগদ্য । তাবলীগে চল্লিশদিন ( চতুর্থ পর্ব)

by .

ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশে আমরা এখন মাঘ-ফাল্গুনের শেষে চৈত্র মাসে (২২ মার্চ, মঙ্গলবার, ১৪৪৩ হিজরি) দাঁড়িয়ে। স্বাভাবিকভাবেই শীতের দাপট কম। ঋতু পরিবর্তনের এই সন্ধিক্ষণে আমাদের বগুড়া আগমন। উত্তরবঙ্গের শীত নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তি এবং এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণার অভাব থাকায় ভ্রান্তিতে ছিলাম। উত্তরবঙ্গে নাকি শীত আগে নামে এবং পরে বিদায় নেয়; যা শরীরের জ্যাকেট ভেদ করে হাড্ডিতে গিয়ে লাগে। পত্রিকায় উত্তরাঞ্চলে হিমেল হাওয়া ও কুয়াশার কারণে বহু লোকের মৃত্যুর খবর পড়েছিলাম। সেই ধারণা থেকে গোপালগঞ্জে শীতের তীব্রতা না থাকলেও উত্তরবঙ্গের শীত মোকাবিলার জন্য সদরিয়া (মুজিবকোট) নিয়ে এসেছিলাম। কিš‘ সারিয়াকান্দি এসে দেখি, এখানে শীত নেই, বরং রাতে ফ্যান চালিয়ে ঘুমোতে হ”েছ। আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়কাল নিশ্চিত না জানার ফলেই এই বিভ্রাট।


শীতের পোশাকে ঠাসা বেডিং-পত্তর বহন করতে বেগ পেতে হ”িছল। শীত না থাকায় গায়ের সদরিয়াটা এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে—এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বা ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’। সফরে হালকা ও সহজে বহনযোগ্য জিনিসপত্র আনাই শ্রেয়, এই বোধ দেরিতে জাগ্রত হলো। ব্যাগে ¯’ান সংকুলান না হওয়ায় নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য রাগে দুঃখে হতাশ হ”িছলাম। এমন সময় একজন সুহৃদ সাথী এগিয়ে এসে আমার সদরিয়াটি তার ব্যাগে নিয়ে নিলেন। জাযাকুমুল্লাহ। বিপদের দিনে সাথী ভাইয়ের এই সহযোগিতা (ইকরাম) মন ভালো করে দিল। এই মুহূর্তটি হৃদয়ের মণিকোঠায় স্মৃতি হয়ে থাকবে। মানবিক আচরণের এই চর্চাই আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ প্রকাশ করে। এমন চমৎকার মানসিকতা ও সহযোগিতা তাবলীগী সফরেই মেলে। কবি বলেছেন:
আপনার লয়ে বিব্রত রহিতে এসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।


আমাদের জামাতের সদস্য সংখ্যা বেশ বড়-তেইশ জনের এক বিরাট কাফেলা। তন্মধ্যে অধিকাংশই তালিবে ইলম, কয়েকজন আলেম ও দুইজন বয়োজ্যেষ্ঠ মুর“ব্বি আছেন। এছাড়া ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ প্রায় সব শ্রেণী-পেশার লোকই জামাতে রয়েছেন। এ যেন ‘এক গাছে রকমারি সব ফুলের সমাহার’। চমৎকার পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিদ্যমান, যা শুধু তাবলীগেই সম্ভব। আল্লাহপাক তাবলীগের নিসবতে আমাদেরকে একত্রিত করেছেন। এই বিপুল সংখ্যক লোকের মধ্যে মাত্র দশজনের পূর্ববর্তী তাবলীগী সফরের অভিজ্ঞতা আছে; বাকি সবাই নবাগত। তাই সবারই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হ”েছ।


মসজিদ পরিবর্তনের সময়কার একটি অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সকালে মাল-সামানা গোছানোর তোড়জোড় শুর“ হলো। সাথীরা যেন নির্বিঘ্নে ও আরামে অব¯’ান করতে পারেন, সেজন্য মুফতি সাহেব হুজুর পূর্ববর্তী মসজিদ পরিষ্কার-পরি”ছন্ন রাখা এবং প্রয়োজনীয় প্রাথমিক প্র¯‘তির ওপর গুর“ত্বারোপ করেন। পরবর্তী মসজিদে রওনা হওয়ার পূর্বে সাথীরা মসজিদ সাফাইয়ের কাজে নিয়োজিত হলেন। মসজিদ পরিবর্তনের সময় পুরো মসজিদ ও টয়লেট সাফসুতরো করে রেখে যাওয়া উত্তম। মুফতি সাহেব হুজুর শ্যেনদৃষ্টিতে সবকিছু তদারক করছেন। তাঁর মতে, পরিষ্কার-পরি”ছন্নতার উপর তাবলীগের সুনাম বা দুর্নাম নির্ভর করে।
সাফাই কার্য শেষে দুই রাকাত নামায পড়ে নিলাম। মুফতি সাহেব হুজুরের নির্দেশনা অনুযায়ী এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদে গমনের সময় জামাতের সাথীদের জন্য দুই রাকাত নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক। নামায শেষে মসজিদের মাঝখানে বেডিং-পত্তরগুলো কেন্দ্রীভূত করে গোলাকার হয়ে বসলাম। মুফতি সাহেব হুজুরের নির্দেশে দুইজন সাথীভাই মসজিদের আনাচে-কানাচে সাঁড়াশি অভিযান চালালেন-মসজিদের কোনো জিনিস আমাদের সামানাপত্তরের সাথে গেল কি না এবং আমাদের কোনো কিছু মসজিদে থেকে গেল কি না- যাচাইয়ের জন্য। তিনি বারবার তাগিদ দি”িছলেন এবং মনে করিয়ে দি”িছলেন যে, “গত তিনদিন মসজিদের প্রত্যেকটি সামগ্রী আমাদের কাছে আমানত ছিল। খেয়াল রাখতে হবে, ‘শেষবেলা’য় যেন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে এবং কারো দ্বারা যেন মসজিদের সামান্য খেয়ানত না হয়।”
শেখ সাদী রহমাতুলস্নাহি আলাইহি গুলি¯ত্মাঁ কিতাবে চমৎকার একটি ঘটনা বলেছেন, নওশিরওয়া বাদশাহ একদিন শিকারে গিয়ে শিকার করে সেখানে বসে মাংস কাবাব করছিলেন। ঘটনাক্রমে লবণ ছিল না। এক খাদেম লবণ আনার জন্য লোকালয়ে গেল। তখন বাদশাহ তাকে ডেকে বললেন, মূল্য পরিশোধ করে লবণ আনবে, অন্যথায় গ্রামে এক খারাপ নিয়ম চালু হবে এবং গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে। খাদেম জবাব দিল, সামান্য জিনিসের পরিমাণে কী ড়্গতি হবে ? বাদশাহ বললেন, এ পৃথিবীতে প্রথম জুলুমের পরিমাণ সামান্য দিয়ে ভিত্তি রচনা করা হয়েছিল; পরে যে আগমন করেছে এটার উপর যোগ করেছে। তাতেই এ পর্যšত্ম পৌঁছেছে। যদি প্রজাদের বাগান থেকে বাদশাহ একটি করে সেব ফল খায় তাহলে তার খাদেমরা ঐ গাছের শিকড় উঠিয়ে নেবে। যদি বাদশাহ পাঁচটি ডিম জুলুম করে খায় তাহলে বাদশাহর সৈন্যরা হাজার হাজার মোরগ মেরে শিক কাবাব করে খেয়ে ফেলবে। কবি শেখ সাদী রহমাতুলস্নাহি আলাইহি বুঝাতে চা”েছন, শাসক কিম্বা আমির যদি ড়্গুদ্রতম অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় তাহলে অধিন¯ত্মরা তার দেখাদেখি বড় বড় অন্যায় করতে দ্বিধাবোধ করবে না।’
মুফতি সাহেব হুজুর আমানতের খেয়ানত ও স্বে”ছাচারিতা বিষয়ে খুব সতর্ক। তাঁর কর্তব্যপরায়ণতা ও দায়িত্ববোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে।


মসজিদ তদারকি পর্ব শেষে বারো কাজের মুযাকারা। এই মুযাকারা বারোটি ভাগে বিভক্ত। সাথিভাইদের নিকট পয়েন্ট নামে সুপরিচিত। এর মধ্যে একটি পয়েন্ট হলো: মসজিদের বাইরে কম যাওয়া। তাবলীগী কাজ নিয়মনীতির ছকে বাঁধা হওয়ায় মসজিদের বাইরে অব¯’ানের সুযোগ কম। এ সফর ঘুম, খাওয়া বা ঘুরে বেড়িয়ে উদাস হওয়ার জন্য নয়; বরং নিজেকে হেদায়েতের আলোয় রাঙানোর অপূর্ব সুযোগ। মুর“ব্বিগণ মুবাল্লিগদেরকে সর্বদা মসজিদের পরিবেশে থাকতে উৎসাহিত করেন। একান্ত প্রয়োজন হলে কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। কৌতূহলবশত সামান্য ফুরসত পেলেই ঘুরাঘুরি করা নিষেধ, কারণ এতে তাবলীগের উদ্দেশ্য ও বরকত নষ্ট হয়। অধিকাংশ সাথী নবীন হওয়ায় তাবলীগের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে (উসুল অনুযায়ী) মানিয়ে চলতে কিছুটা বেগ পেতে হ”েছ।


প্রচলিত তাবলীগ জামাতকে চলন্ত মাদ্রাসা বলা হয়। মুফতি সাহেব হুজুর যাত্রা শুর“র পূর্বে যারা কম জানেন, তাদের জাননেওয়ালা সাথীদের হাওলা করে দিলেন। ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন সকলে নিঃসঙ্কোচে প্রয়োজনীয় দোয়াগুলো চলতে ফিরতে শিখছেন এবং অপরকে শেখা”েছন। সবাই তালিবে ইলম। মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, “দাওয়াত ও তাবলীগ কা কাম তালিবে ইলম বানানে কা কাম হ্যায়, আলিম বানানে কা নেহী” (দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ তালিবে ইলম বানানোর কাজ, আলিম বানানোর কাজ নয়)।
রাস্তায় চলার সময় একজন মুবাল্লিগের আচরণ কেমন হবে, সে বিষয়ে মুফতি সাহেব হুজুর বিশদভাবে বলে দিয়েছেন: ১. বড় রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলা। ২. সালামে-কালামে চলা। ৩. জিকিরে-ফিকিরে চলা। ৪. সালামের উত্তর দেওয়া। ৫. নযরের হেফাজত করা। ৬. শিখতে-শিখাতে চলা। ৭. রাস্তায় কোনো কষ্টদায়ক জিনিস থাকলে তা সরিয়ে দেওয়া বা পিছনের সাথীকে বলে দেওয়া। ৮. সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা।


উপজেলা স্বা¯’্য কমপ্লেক্স মসজিদ অভিমুখে আমরা পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছি। আগামী তিনদিনের জন্য উক্ত মসজিদে আমাদের ‘রোখ’ (অব¯’ান)। এটি পাঁচ-সাত মিনিটের হাঁটা দূরত্ব। নতুন জায়গা নিয়ে অবচেতন মনে একটা চাপা উত্তেজনা ও কৌতূহল কাজ করছে। স্বা¯’্য কমপ্লেক্স মসজিদে পৌঁছে মনটা প্রসন্ন হয়ে গেল। চমৎকার পরিপাটি পরিবেশ। মসজিদের উত্তর পাশ জুড়ে সবুজ শ্যামল ধানক্ষেত। রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে হওয়ায় শব্দ দূষণের ভয় নেই। আগামী তিনটা দিন নিরিবিলি কাটবে।
মসজিদ সংলগ্ন বাঙালী নদী (যমুনার শাখা)। এঁকেবেঁকে চলতে চলতে দৃষ্টির শেষ সীমা অতিক্রম করে কোথায় যেন চলে গেছে। স্ব”ছ টলমলে সুন্দর পানি। এই তপ্ত দুপুরে নদীর সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে অপরিমেয়। দুপুরবেলার তীব্র তাপদাহে একটুখানি আরামের আশায় কয়েকজন সাথীভাই নদীতে গোসল করার ইরাদা করেছেন।
নদীর জলে ছোট ছোট ঢেউ, একজন মাঝি ভয়ডরহীনভাবে সাবলীল গতিতে নৌকা নিয়ে গন্তব্যে যা”েছন। পানির দেশের মানুষ হয়েও এখনো নৌকা চালনা আয়ত্তে আনতে না পারার লজ্জা রয়েছে। শৈশবে নৌকা চালাতে গিয়ে ভেসে গিয়েছিলাম মাঝ নদীতে। নৌকা বাওয়া সম্পর্কিত আমার কোনো সুখস্মৃতি নেই। গোসলের বিরতিতে সাথীরা দলবেঁধে নদীতে অবগাহন করতে যা”েছন। সাথীদের অনুরোধ সত্ত্বেও ব্যক্তিগত কিছু কারণে বিরত থাকতে হলো। বয়স বাড়লে অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment