গাজায় বিতর্কিত জিএইচএফের দেওয়া ত্রাণ নিতে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির ভিড়। ২৭ মে, রাফাহছবি: রয়টার্স
ফিলিস্তিনের গাজা নগরের রাফাহ এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে খাদ্য নিতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৬ জন, নিখোঁজ রয়েছেন আরও ৭ ফিলিস্তিনি। গাজার কর্তৃপক্ষ সূত্রে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের বিতর্কিত একটি সংস্থা এই সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে এই ত্রাণকাজ পরিচালিত হচ্ছে। সমালোচকেরা মনে করেন, গাজার প্রকৃত মানবিক প্রয়োজনের বদলে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই বিতরণ ব্যবস্থা চালু করেছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র।
জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণের খবর শুনে সেখানে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি ভিড় করেন। তবে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে হতাহতের ঘটনাটি সংস্থাটি অস্বীকার করেছে।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সাংবাদিকরা জানান, ত্রাণকেন্দ্রের সামনে বহু ক্ষুধার্ত মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলেন। কারণ, সাহায্য দেওয়ার আগে প্রত্যেককে তল্লাশি করে ঢোকানো হচ্ছিল। এতে অনেক দেরি হচ্ছিল। এই দেরির কারণে তারা হঠাৎ করে ভেতরে ঢুকে পড়েন। এরপরই বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, আর তখনই শোনা যায় গুলির শব্দ। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে পরিচালিত বিতর্কিত জিএইচএফের সাহায্য বিতরণ কর্মসূচি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে জিএএইচএফের সঙ্গে জড়িত মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধার করতে তৎপরতা শুরু করা হয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আরও দাবি করেছে, তারা ত্রাণ নিতে আসা মানুষের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়নি। তবে ঘটনাস্থলে গুলির শব্দ শোনা যায়, যা হয়তো ওই কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মার্কিন ভাড়াটে প্রহরীদের সতর্কতামূলক গুলি হতে পারে।
গাজার সরকারি জনসংযোগ অফিস জানিয়েছে, ‘আজকের ঘটনা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয়, দখলদার ইসরায়েল যে মানবিক সংকট ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করেছে, তা সামাল দিতে সম্পূর্ণভাবে তারা ব্যর্থ।’
জনসংযোগ বিভাগ বলেছে, ‘এই খাদ্য নিরাপত্তায় বিপর্যয়ের জন্য আমরা দখলদার ইসরায়েলকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করছি। আইনগত ও নৈতিক—উভয় দিক থেকে তারা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।’
জনসংযোগ অফিস আরও বলেছে, গাজার চারদিকে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় এই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য, খাবার, ওষুধ বা জ্বালানি ভেতরে ঢুকতে পারছে না।
জিএইচএফের ত্রাণ নিয়ে সন্দেহ
ত্রাণকেন্দ্রে এই বিশৃঙ্খলার আগে গত সোমবার গাজায় জিএইচএফের পক্ষ থেকে কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়। ছবিতে দেখা যায়, কিছু পুরুষ বড় বড় কার্টন হাতে নিয়ে ক্যামেরার বিপরীতে হেঁটে যাচ্ছেন। এমন একটি পথ দিয়ে তাঁরা যাচ্ছেন, যার দুই পাশে কাটাতারের বেড়া। দেখতে অনেকটা সামরিক এলাকার মতো।
জিএইচএফের দাবি, এগুলো তাদের খাদ্য সাহায্য বিতরণ কার্যক্রমের শুরু।
তবে গাজায় বসবাসরত মানুষ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা এসব ছবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

গাজায় বিতর্কিত জিএইচএফের দেওয়া ত্রাণ নিচ্ছেন গাজার এক ব্যক্তি। ২৭ মে, রাফাহছবি: এএফপি
অনেকেই বলেছেন, এটি ‘সাজানো নাটক’, যার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে এই নতুন বিতরণ প্রক্রিয়ায় আকৃষ্ট করা। জিএইচএফ নিয়ে সমালোচনা থামাতে এই কৌশল নেওয়া হয়েছে।
জিএইচএফ প্রথমবার আলোচনায় আসে এই মাসের শুরুতে, যখন জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছে ইসরায়েল তাদের নতুন পরিকল্পনার ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করে। তারা গাজায় ত্রাণ বিতরণ পরিকল্পনার মাধ্যমে সেখানকার সাহায্য বিতরণ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে চায় এবং একে সীমাবদ্ধ করে দিতে চায়।
জিএইচএফের এ ধরনের ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংগঠন ও দেশ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
জাতিসংঘ
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের চিত্র হৃদয়বিদারক।
ডুজারিক বলেন, ‘আমরা ও আমাদের অংশীদারদের একটি সুসংগঠিত ও নীতিনির্ভর পরিকল্পনা আছে, যা গাজা, সুদান, মিয়ানমারসহ যেখানেই হোক—সব জায়গায় একই মানবিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।’
মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, জিএইচএফের পরিকল্পনা মানবিক মানদণ্ড পূরণ করে না।
ফিলিস্তিন
গাজার সরকারি গণসংযোগ অফিস এই ঘটনাকে ‘ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড’ ও ‘পূর্ণমাত্রার যুদ্ধাপরাধ’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
জনসংযোগ অফিস জানায়, ‘সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষুধার্ত মানুষকে সাহায্যের প্রলোভন দেখিয়ে সেখানে ডেকে এনে গুলি চালিয়েছে।’
ইসরায়েল
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেন, ‘জিএইচএফের ত্রাণবিতরণ কেন্দ্রে কিছু সময়ের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তবে আমরা তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনি।’
নেতানিয়াহু আরও দাবি করেন, ‘গাজায় কেউ অপুষ্টিতে ভুগছে, এমন প্রমাণ নেই। যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একজন কৃশকায় লোকও দেখা যায়নি।’
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এই ঘটনাকে কেবল ‘অভিযোগ জানানোর কৌশল’ বলে অবজ্ঞা করেন। তিনি বলেন, ‘হামাস এই সাহায্য কার্যক্রমকে বাধা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে।’
ট্যামি ব্রুস দাবি করেন, এই মুহূর্তে গাজায় ৮ হাজার খাবার প্যাকেট সরবরাহ করা হয়েছে। জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও সাহায্য কার্যক্রম চলছে।’
জিএইচএফ
বিতর্কিত সহায়তা সংস্থা জিএইচএফ দাবি করেছে, ‘একসময় বিকেলে এত মানুষ ভিড় করেছিল যে, আমাদের কর্মীরা পেছনে সরে যায়, যেন কিছু মানুষ নিরাপদে সাহায্য নিতে পারে।’
সংস্থাটি জানায়, তারা প্রায় ৮ হাজার খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছে, যা গড়ে ৫ দশমিক ৫ জন মানুষকে ৩ দশমিক ৫ দিন খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট।
রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল
এই সংস্থার নীতিমালাবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্ডিন ল্যাং বলেন, ‘এই ত্রাণ কার্যক্রম মানবিক নয়, বরং সামরিকভাবে পরিকল্পিত।’
হার্ডিন বলেন, ‘ক্ষুধা থেকে মানুষকে বাঁচাতে খাদ্য ছাড়াও চিকিৎসা, অপুষ্টি কেন্দ্রের প্রয়োজন হয়। এসব কিছুই এই পরিকল্পনায় নেই।’
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি)
এই সংস্থার মুখপাত্র আহমেদ বায়রাম বলেন, এই সাহায্য বিতরণ পদ্ধতি মানবিক নয়। তিনি আরও বলেন, যে দেশ রাফাহ ধ্বংস করেছে, মানুষকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে—এখন সেই তারাই আবার সেখানে সাহায্য নিতে বলছে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।