আব্বাসী যুগে ঈদের বাজারপ্রতীকি ছবি
মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে ঈদের উৎসব ছিল সাধারণ কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে গভীর। তবে পরবর্তী ইসলামি সাম্রাজ্যগুলোতে—উমাইয়া, আব্বাসি, ফাতেমি ও মামলুক যুগে ঈদুল আজহা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, বিশাল মিছিল এবং সমাজব্যাপী কোরবানির মাধ্যমে একটি গৌরবময় উৎসবে রূপান্তরিত হয়। এ প্রবন্ধে আমরা ইসলামি ইতিহাসে ঈদুল আজহার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যাপন, কোরবানির অনুষ্ঠানের বিবর্তন ও এর সমাজে প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
উমাইয়া যুগ: রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবে উত্থান
উমাইয়া খিলাফত (৪১-১৩২ হি./৬৬১-৭৫০ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে রাষ্ট্রীয় মাত্রা প্রদান করে। ইবনে কাসির (মৃ. ৭৭৪ হি.) তাঁর ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, খলিফা মারওয়ান ইবনে হাকাম (মৃ. ৬৫ হি.) ঈদের নামাজের আগে খুতবা দেওয়ার প্রথা শুরু করেন। এ খুতবায় রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হতো, যা খিলাফতের বৈধতা ও শক্তি প্রদর্শন করত। উমাইয়া খলিফারা নবীজি (সা.)-এর হারবা (বর্শা) ও বুরদা (চাদর) ব্যবহার করে তাঁদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতীকায়িত করতেন।
খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ঈদুল আজহার সময় দামেস্কের প্রধান মসজিদে বিশাল পরিসরে কোরবানির আয়োজন করতেন। তিনি নিজে কোরবানির পশু জবাই করতেন এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন।
পশু কোরবানির প্রচলনও উমাইয়া যুগে ব্যাপক গুরুত্ব পায়। ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হি.) উল্লেখ করেন, খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান (মৃ. ৮৬ হি.) ঈদুল আজহার সময় দামেস্কের প্রধান মসজিদে বিশাল পরিসরে কোরবানির আয়োজন করতেন। তিনি নিজে কোরবানির পশু জবাই করতেন এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। এ প্রচলন জনগণের মধ্যে খলিফার উদারতা ও ধার্মিকতার প্রতিচ্ছবি তৈরি করত। উমাইয়া শাসকেরা প্রায়ই বিদ্রোহী অঞ্চলের নেতাদের ঈদের ভোজে আমন্ত্রণ জানাতেন, যা রাজনৈতিক মিলনের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করত।
আব্বাসি যুগ: গৌরব ও দানশীলতা
আব্বাসি খিলাফত (১৩২-৬৫৬ হি./৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে রাষ্ট্রীয় উৎসবে রূপান্তরিত করে। ইবনে জাওজি (মৃ. ৫৯৭ হি.) তাঁর ‘আল-মুনতাজাম’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, খলিফা মুক্তাফি (মৃ. ৫৫৫ হি.) ৫৫৩ হিজরিতে (১১৫৮ খ্রি.) ঈদুল আজহার জন্য একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করেন। এ মিছিলে অশ্বারোহী সৈন্য, সোনায় সজ্জিত ঘোড়া ও বহু আমির, এমনকি ফকিহরাও অংশ নিতেন। মিছিলটি বাগদাদের প্রধান রাস্তা দিয়ে যেত এবং জনগণ তাকবির ধ্বনি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাত।
খলিফা মুক্তাফি ঈদুল আজহার জন্য একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করেন। এ মিছিলে অশ্বারোহী সৈন্য, সোনায় সজ্জিত ঘোড়া ও বহু আমির, এমনকি ফকিহরাও অংশ নিতেন।
কোরবানির মাংস বিতরণ আব্বাসি যুগে একটি বড় সামাজিক ঘটনা ছিল। সুয়ুতি (মৃ. ৯১১ হি.) তাঁর তারিখ–উল–খুলাফা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, খলিফা মামুন (মৃ. ২১৮ হি.) ঈদুল আজহার সময় হাজারো পশু কোরবানি করতেন। পশুর মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হতো এবং খলিফার প্রাসাদে বিশাল ভোজের আয়োজন করা হতো। এ ভোজে ফকিহ, কবি, এমনকি সাধারণ জনগণও আমন্ত্রিত হতেন। মামুন নিজে ভোজে উপস্থিত থেকে খাবার পরিবেশন করতেন।
ইবনে তাগরিবারদি (মৃ. ৮৭৪ হি.) একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণনা করেন, ২৩৭ হিজরিতে (৮৫২ খ্রি.) খলিফা মুতাওয়াক্কিল ঈদুল আজহার দিনে একজন বিদ্রোহীর মৃতদেহ তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন। এ ঘটনা জনগণের মধ্যে ব্যাপক আনন্দের সৃষ্টি করে এবং খলিফার দয়ার প্রশংসা করা হয়। এ ধরনের কাজগুলো ঈদুল আজহাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক মিলনের একটি মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ফাতেমি যুগ: বৈচিত্র্য ও উৎসব
ফাতেমি খিলাফত (২৯৭-৫৬৭ হি./৯০৯-১১৭১ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে একটি বর্ণিল ও সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত করে। মাকরিজি (মৃ. ৮৪৫ হি.) তাঁর ইত্তিআজ আল-হুনাফা গ্রন্থে বর্ণনা করেন, খলিফা আজিজ (মৃ. ৩৮৬ হি.) ঈদের নামাজের জন্য কায়রোর বিশাল মাঠে বিশেষ মঞ্চ (মাসাতিব) নির্মাণ করতেন। এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন ও ফকিহরা তাকবির ধ্বনি দিতেন এবং জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে সেখানে অংশ নিত।
ইবনে কাসির উল্লেখ করেন, মামলুক সুলতান বাইবার্স ঈদুল আজহার সময় কারাবন্দীদের মুক্তি দিতেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দীদের।
ফাতেমিদের সময়ে কোরবানির করার আয়োজন ছিল অত্যন্ত সংগঠিত। ইবনে তাগরি বারদি উল্লেখ করেন, ফাতেমি খলিফারা ঈদুল আজহার জন্য হাজারো পশু ক্রয় করতেন। পশুগুলো কায়রোর প্রধান মাঠে জবাই করা হতো এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষণ করা হতো।
ফাতেমিদের একটি উল্লেখযোগ্য প্রথা ছিল ‘ঈদিয়া’ বা ঈদ উপহার। মাকরিজি বর্ণনা করেন, খলিফারা ফকিহ, সুফি, এমনকি অমুসলিম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ঈদিয়া হিসেবে নগদ অর্থ, পোশাক ও মিষ্টান্ন উপহার দিতেন। একটি মজার প্রথা ছিল মিষ্টির ভেতরে সোনার দিনার লুকিয়ে রাখা, যা অতিথিদের সীমাহীন বিস্ময় ও আনন্দ জোগাত।
ফাতেমিদের ঈদের ভোজও বিখ্যাত ছিল। মাকরিজি উল্লেখ করেন, খলিফা মুসতানসিরের (মৃ. ৪৮৭ হি.) ঈদুল আজহার ভোজে ৩০০ রকমের খাবার পরিবেশন করা হতো। এ ভোজে কুসকুস, হারিসা ও বিভিন্ন মিষ্টান্ন যেমন খুশকনান (মিষ্টি রুটি) ও বেসতানদুদ (মিষ্টি পিঠা) থাকত। ভোজসভাগুলো শুধু আনন্দের নয়; বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল।

ঈদুল আজহার ভোজে ৩০০ রকমের খাবার পরিবেশন করা হতোপ্রতীকি ছবি
মামলুক যুগ: সামাজিক সংহতি
মামলুক সালতানাত (৬৪৮-৯২৩ হি./১২৫০-১৫১৭ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে সামাজিক সংহতির একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করত। ইবনে কাসির উল্লেখ করেন, মামলুক সুলতান বাইবার্স (মৃ. ৬৭৬ হি.) ঈদুল আজহার সময় কারাবন্দীদের মুক্তি দিতেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দীদের।
কোরবানির মাংস বিতরণ মামলুক যুগে একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়ায় চলে আসে। ইবনে বতুতা (মৃ. ৭৭৯ হি.) তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে বর্ণনা করেন, ৭৩৩ হিজরিতে (১৩৩৩ খ্রি.) তিনি কায়রোর একটি ঈদ উদ্যাপন দেখেছিলেন। সুলতানের প্রাসাদে ফকিহ, শায়খ ও দরিদ্রদের জন্য পৃথক ভোজের আয়োজন করা হয়। কোরবানির মাংস বিশেষভাবে দরিদ্র এলাকায় পাঠানো হয়।
মামলুক যুগে ঈদের মিছিলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য প্রকাশ পেত। ইবনে তাগরিবারদি বর্ণনা করেন, মামলুক সুলতানরা সোনায় সজ্জিত ঘোড়া, জিরাফ ও হাতির মিছিলের আয়োজন করতেন। এ মিছিলগুলো শুধু রাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শন করত না; বরং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করত।
বাগদাদে এক ঈদে নারী কবি উবায়দা আল-জুহানিয়া খলিফার সামনে কবিতা আবৃত্তি করেন। তাঁর কবিতায় তিনি কোরবানির ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রশংসা করেন, যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
সামাজিক প্রভাব
ঈদুল আজহা ইসলামি সাম্রাজ্যগুলোতে সামাজিক ঐক্যের একটি প্রধান মাধ্যম ছিল। কোরবানির মাংস বিতরণ ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমাত এবং সমাজে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত করত। ইমাম শাফিঈ (রহ.) তাঁর আল-উম্ম গ্রন্থে উল্লেখ করেন, কোরবানির মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা ওয়াজিব, যা সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতার শিক্ষা দেয়।
ঈদের ভোজ ও মিছিল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের সুযোগ করে দিত। ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন, তুরস্কের একটি ঈদের ভোজে তিনি খ্রিষ্টান ও ইহুদি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেখেছিলেন, যাঁরা মুসলিম শাসকের সঙ্গে খাবার ভাগ করে নিয়েছিলেন। এ ধরনের সমাবেশগুলো ধর্মীয় সহনশীলতা ও সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক ছিল।
ঈদুল আজহা ছিল সাহিত্য ও কবিতার মঞ্চ। তানুখি (মৃ. ৩৮৪ হি.) বর্ণনা করেন, বাগদাদে এক ঈদে নারী কবি উবায়দা আল-জুহানিয়া খলিফার সামনে কবিতা আবৃত্তি করেন। তাঁর কবিতায় তিনি কোরবানির ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রশংসা করেন, যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। এ সাহিত্যিক সমাবেশগুলো ঈদকে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত করত।
(আলজাজিরা ডট নেট অবলম্বনে)