ছবি : এএফপি
ইরান-ইসরায়েল হামলা পাল্টা হামলার মধ্যে ইরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এছাড়া সরাসরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে লক্ষ্যবস্তু করার ইঙ্গিতও দিয়েছেন তারা।
তবে ইতিহাস বলছে, ইরান এই ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের স্বাদ বহু আগেই পেয়েছে—তাও আবার যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপে।
১৯৫৩ সালের সেই ইরান অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট শাহ সরকার ক্ষমতায় আসে।
প্রায় ২৭ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আরেক অভ্যুত্থানে তাদের পতন ঘটে, সূচনা হয় ইরানের ইসলামি শাসনের।
সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে ইরান অভ্যুত্থানের ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে।
তেলক্ষেত্র ঘিরে উত্তেজনার সূচনা
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সহায়তায় ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোসাদ্দেক তার দেশের তেলক্ষেত্র জাতীয়করণে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।
এ পদক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন নিজেদের স্বার্থে আঘাত দেখেছিল।
স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘প্রতিরোধ’
তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ইরানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও, তখনকার সময়ে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতির ইঙ্গিত হিসেবে দেখেছিল পশ্চিমা বিশ্ব। এ প্রেক্ষাপটে, মোসাদ্দেকের পতনে কাজ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের গোপন সংস্থাগুলো।
শাহকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে অভিযান
যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভি শাহকে শক্তিশালী করা এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জেনারেল ফজলুল্লাহ জাহেদিকে বসানো।
সিআইএ ও ব্রিটিশ গোপন সংস্থা এসআইএস প্রথমে তীব্র প্রচারণা চালিয়ে মোসাদ্দেকবিরোধী মনোভাব উসকে তোলে।
এরপর ১৯৫৩ সালে তারা প্রো-শাহ সেনাদের একত্রিত করে রাস্তায় নামায়। সেনাবাহিনীও পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। কেবল দুই দিনের মধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রীর হাতে পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে দেয় সিআইএ—এমন তথ্য উঠে এসেছে গোপন নথিপত্রে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকারোক্তি
২০১৩ সালে সিআইএর গোপন দলিল প্রথমবারের মতো প্রকাশ করা হয়, যাতে অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে।
যদিও আগেই ২০০৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
মোসাদ্দেককে সরিয়ে শাহকে আরও শক্তিশালী করা হলেও ইরানিদের এক বড় অংশ এতে প্রবল ক্ষুব্ধ হন। একদিকে একনায়কতন্ত্র, অন্যদিকে বিদেশি হস্তক্ষেপ—দুইয়ের বিরুদ্ধেই জমে ওঠে ক্ষোভ। এটি পরবর্তী কয়েক দশকজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবের বীজ বপন করে।
ইসলামি বিপ্লব ও পশ্চিমের পতন
শাহ প্রশাসনের যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া সরকার হয়ে থাকার মনোভাব বুঝতে সময় লাগেনি ইরানিদের। পরে এই ক্ষোভ রূপ নেয় গণআন্দোলনে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে লাখো মানুষ রাজপথে নেমে আসে শাহবিরোধী বিক্ষোভে। কেউ তার আধুনিকতাবাদে ক্ষুব্ধ, কেউ একনায়কতন্ত্রে বিরক্ত। সবশেষে, ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পশ্চিমাপন্থী রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের শরিয়াভিত্তিক শাসনের সূচনা হয়।
বর্তমান সংকটে অতীতের প্রতিধ্বনি
আজ যখন ইরানের শীর্ষ নেতাকে সরিয়ে দেওয়ার কথা উঠে আসছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, তখন অনেক ইরানির মনেই জেগে উঠছে ১৯৫৩ সালের সেই ইতিহাস। কারণ তারা জানে—বিদেশি হস্তক্ষেপ যে কত গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে, তার প্রমাণ তারা নিজেরাই।