ইসরায়েলি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের জানাজায় অংশ নিচ্ছেন শোকাহত ব্যক্তিরা। ইরানের আহভাজ শহরে, ১৯ জুন ২০২৫ছবি: রয়টার্স
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসে ইসরায়েলের পাশে সামরিকভাবে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তিনি দুই সপ্তাহ সময় নিয়েছেন। অন্যদিকে ইরানে আগ্রাসন চালানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে ইসরায়েল বলছে, দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই তারা দেশটিতে আগাম হামলা চালিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচিত জাতিসংঘ সনদ এক দেশের ওপর অন্য দেশের কোনো ধরনের আগ্রাসনকে অনুমোদন করে না। সনদটি শুধু আত্মরক্ষার প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ অনুমোদন করে। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সব ধরনের দ্বন্দ্ব শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। ব্যর্থ হলে বলপ্রয়োগের বৈধতা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে।
নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা চলার মধ্যেই কোনো দেশ আক্রান্ত হলে সে দেশের ‘ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত আত্মরক্ষার স্বাভাবিক অধিকার’ থাকে। মানে আক্রান্ত দেশও হামলাকারী দেশের ওপর ন্যায়ানুগভাবে পাল্টা হামলা চালাতে পারবে।
ইরানে আগেভাগে হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার দাবি করা কতটা আন্তর্জাতিক আইনে যুক্তিসংগত, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। ইসরায়েল যদি প্রমাণ করতে পারে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, তবে সেই আগাম হামলা বৈধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ইসরায়েল ও তার মিত্রদের জন্য এটাই এখন আইনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।

ইরানের ইস্পাহান শহরে পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্রের বিভিন্ন ভবন। স্যাটেলাইট ছবিতে ধারণকৃত, ১৭ মে ২০২৫ছবি: রয়টার্স
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানে হামলা আত্মরক্ষামূলক নয়
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ নয়, আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞদের অনেকে এমন মতই দিচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক সদস্য মার্কো মিলানোভিচ বলেন, ইরান হামলা চালিয়েছে, ইসরায়েল সেই হামলার জবাব দিচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু তেমন নয়। ইরান সরাসরি বা হুতির মতো নিজেদের সহায়তাপুষ্ট (প্রক্সি) কোনো বাহিনী দিয়ে ইসরায়েলে আগে হামলা চালায়নি, ইসরায়েলকে যার জবাব দিতে হচ্ছে। বরং ইসরায়েলই আগেভাগে ইরানে হামলা চালিয়েছে।
ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল ল সম্পাদক মার্কো মিলানোভিচ বলেন, ব্যাপক পরিসরে ব্যাখ্যা করলেও ইসরায়েলের এ হামলাকে যুক্তিযুক্ত বলা যায় না।
এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক মারিয়া গাভুনেলিও মার্কো মিলানোভিচের সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় আগ বাড়িয়ে আগ্রাসন চালানো আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।’
তবে পারমাণবিক অস্ত্রকে অনেক সময় ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গাভুনেলির মতে, আত্মরক্ষার যুক্তি দাঁড় করাতে ইসরায়েলকে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) এমন কোনো প্রতিবেদনের প্রমাণ দিতে হবে ইসরায়েলকে।
যুক্তরাজ্যের প্রধান আইন উপদেষ্টা দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্যের সেনাদের ওপর হামলা না হলে ইরানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সামরিক অভিযানে জড়ানো উচিত নয়।’ স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন।
ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির বিষয়ে আইএইএ প্রমাণ দিয়েছে কি
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে—এ বিষয়ে আইএইএ স্পষ্ট কোনো প্রমাণ দেয়নি। তবে তারা ইরানের কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে যাচাই করতেও সক্ষম হচ্ছে না। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ রেখেছে ইরান।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নেতৃত্বে ২০১৫ সালে ছয় বিশ্বশক্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইরানের সঙ্গে ‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ)’ সই করে, যা সংক্ষেপে ইরান পারমাণবিক চুক্তি নামে পরিচিত। ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য এ চুক্তি করা হয়েছিল, যাতে দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে। কিন্তু ২০১৮ সালে তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসন এ চুক্তি থেকে একতরফা বের হয়ে যায়। ফলে চুক্তিটি একরকম বাতিল হয়ে যায়।

ইসরায়েলের বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইরানের আরাক হেভি ওয়াটার চুল্লি। স্যাটেলাইট ছবিতে ধারণকৃত, ১৯ মে ২০২৫ছবি: রয়টার্স
৯ জুন আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেন, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মানছে না। এতে দেশটির কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ কি না, যাচাই করার সক্ষমতা অনেক কমে গেছে।
গ্রোসি জানান, ভেরামিন, মারিভান ও তুরকুজাবাদে ইউরেনিয়াম কণার উপস্থিতি নিয়ে আইএইএ যেসব প্রশ্ন করেছিল, ইরান সেসবে হয় বারবার চুপ থেকেছে, নয়তো কারিগরি দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছে। এমনকি এসব জায়গা ‘স্যানিটাইজ বা তথ্য গোপনের উদ্দেশ্যে সাফ করার’ চেষ্টাও করেছে।
ইরানের ‘দ্রুতগতিতে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত করাকেও গুরুতর উদ্বেগের’ বিষয় বলে মন্তব্য করেন গ্রোসি।
গ্রোসি জানান, ইরান ফর্দো ও নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনায় ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। এমনকি ২০২৩ সালে ফর্দোতেই ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ৯০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হয়। ২০১৫ সালের চুক্তি অনুযায়ী ইরানের ৫ শতাংশের বেশি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম না রাখার কথা ছিল।
এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সামরিক হামলার আগের দিন ১২ জুন আইএইএর গভর্নর বোর্ডে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ইরান আন্তর্জাতিক পরমাণু নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘন করছে।
কিন্তু গতকাল শুক্রবার গ্রোসি জোর দিয়ে বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ‘পদ্ধতিগত চেষ্টা’ চালাচ্ছে, আইএইএ এমন কোনো প্রমাণ পায়নি। ইরান গ্রোসির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকির পর তিনি এ মন্তব্য করেছেন।
ইরান বলেছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সদস্য। চুক্তি অনুযায়ী তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করবে না। নিজেদের কয়েকটি স্থানে উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পাওয়ার বিষয়টিকে তারা নাশকতা বা কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনার ফল বলে দাবি করেছে।
কিন্তু ইসরায়েলের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশটির আইনপ্রণেতারা এখন তেহরানকে এনপিটি থেকে সরিয়ে নেওয়ার একটি খসড়া আইন তৈরির কাজ করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের থ্রি-ডি প্রিন্ট করা ক্ষুদ্রাকৃতি মডেলের পাশে ইসরায়েল ও ইরানের পতাকাছবি: রয়টার্স
আত্মরক্ষার নামে আগাম হামলার নজির আছে কি
১৯৮১ সালে ‘অ্যান্টিসিপেটরি সেলফ-ডিফেন্স’ বা আগাম আত্মরক্ষার যুক্তি দেখিয়ে ইরাকের অসমাপ্ত ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দিয়েছিল ইসরায়েল। চুল্লিটি নির্মাণ করছিল একটি ফরাসি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ৪৮৭ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে ওই হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, এটি জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন এবং ইরাকসহ অন্যান্য দেশের শান্তিপূর্ণ উন্নয়নে পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণের সার্বভৌম অধিকারের লঙ্ঘন।
প্রস্তাবে এ-ও বলা হয়েছিল, ইসরায়েল তখনো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) সই করেনি। বর্তমানে ইসরায়েলের কাছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময়েও আত্মরক্ষায় আগাম হামলার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একদিন ইরাক ‘সন্ত্রাসীদের সহায়তায়’ যুক্তরাষ্ট্রে গণবিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে পারে। কিন্তু জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকেরা বলেছিলেন, ইরাক এমন অস্ত্র তৈরি করছে, এর পক্ষে দৃঢ় কোনো প্রমাণ নেই।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বুশের ইরাকে হামলা চালানোর অনুমোদন দেয়নি। তা সত্ত্বেও ‘ইচ্ছুক জোট’ নিয়ে ইরাকে হামলা চালান বুশ। ইরাক দখলের পরও বিদেশি সেনারা সেখানে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পাননি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডানে) ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুমে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ছবি: রয়টার্স
২০১৮ সালে ইসরায়েল জানায়, ১১ বছর আগে তারা সিরিয়ার একটি পারমাণবিক চুল্লিতে বোমা মেরেছিল। তখন প্রায় চালু হওয়ার পথে ছিল সেটি। তাদের ধারণা ছিল, সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাচ্ছিল।
‘অপারেশন আউটসাইড দ্য বক্স’ নামের অভিযানের মাধ্যমে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার দেইর আজ জুর শহরের ওই পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করে ইসরায়েল। উত্তর কোরিয়ার তৈরি এই চুল্লিতে প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের কথা ছিল। তখনো ইসরায়েলের যুক্তি ছিল, তারা সিরিয়ার সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলার বিরুদ্ধে আগেভাগেই হামলা চালিয়েছে।