Home শিল্প সাহিত্যসিরাতসংখ্যা । কংক্রিটের শহরে ইয়াসরিবের বাতাস

সিরাতসংখ্যা । কংক্রিটের শহরে ইয়াসরিবের বাতাস

by .
কংক্রিটের শহরে ইয়াসরিবের বাতাস


আদিল মাহমুদ

হাজারো আলো ঝলমল করছে শহর জুড়ে। আকাশচুম্বী বিলবোর্ডে একসাথে ভেসে ওঠে বিজ্ঞাপনের রঙিন ঢেউ—ভোগের ডাক, বিলাসের প্রতিশ্রুতি। কোথাও চকচকে গাড়ির প্রতিচ্ছবি, কোথাও ত্বকের মায়াবী প্রতারণা, কোথাও আবার সুখের নামে বিক্রি হচ্ছে মরীচিকা। ট্যাক্সির হর্ন বাজে নিরবচ্ছিন্ন, সাবওয়ের গর্জন ছুটে যায় শহরের নীচে, লাল-নীল-সবুজ আলোর ফ্ল্যাশে মানুষরা অস্থির ঝড়ের মতো ছুটে চলে। যেনো প্রতিটি পা দৌড়াচ্ছে অজানা কোনো ফিনিশ লাইনের দিকে।

দাঁড়িয়ে আছি সেসব ভিড়ের মাঝেই—অন্ধকারের কোণে, নিজের নিঃশব্দতার সাথে। চারপাশে হাজার কণ্ঠস্বরের কোলাহল—অথচ ভেতরে কেবল নিস্তব্ধ প্রশ্ন।

প্রতিটি রাস্তার মোড়ে দেখি ছুটে চলা অচেনা মুখ। মেট্রোরেলের ভিড়ে ঠাসা ক্লান্ত দেহ, বাসের জানালা ভেদ করে উঁকি দেয় নির্জীব চোখ, অফিসের কাঁচঘেরা ঘরে হারিয়ে যায় ব্যস্ততার বন্দি মন। কেউ কারও দিকে তাকায় না, কেউ কারও চোখে রাখে না। উদাসীনতার সেই অচেনা স্রোতে ভেসে আসে প্রশ্ন—‘এই জীবন কি শুধু দৌড়ের প্রতিযোগিতা?’ কোলাহল, তাড়াহুড়া, হিংসা—সব কিসের জন্য? সুখ কোথায়? শান্তি কোথায়?

ঠিক তখনই মনে ভেসে ওঠে একটি নাম।
নামটি আমি শুনেছি শৈশবে—আম্মার ঠোঁটে মিষ্টি দোয়ার মতো, মসজিদের মাইকে ভেসে আসা আযানের সুরে, অচেনা হুজুরের খুতবার স্নিগ্ধ ধ্বনিতে, কিংবা পুরনো কাগজে ছাপা কোনো কিতাবের পৃষ্ঠায়। সেই নাম উচ্চারণ করলেই মনে হয়, মরুভূমির বালুর উপর দিয়ে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে—কংক্রিটের শহরেও যেনো মুহূর্তে শান্তির ঠাণ্ডা ছায়া নেমে আসছে।

ভাবি, তিনি কীভাবে বেঁচেছিলেন এমন নগরে, যেখানে তাঁর প্রতি ছিল ঘৃণা, বিদ্রূপ, অবমাননা। গলির কোনায় কেউ ছুঁড়ে দিত পাথর, কেউ দিত তীব্র শ্লেষ, কেউ হাসতো বিদ্রূপে। তবুও তিনি থেমে যাননি। দুঃখের গলিঘুপচি, ভাঙা দোকানের পাশে, বস্তির দরিদ্র ঘরগুলোর আঙিনায় দাঁড়িয়ে, মানুষের ক্ষিপ্ত দৃষ্টির মাঝেও তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন শুধু শান্তির বাণী।

তাঁর মুখে কোনো ক্রোধ ছিলো না, চোখে কোনো প্রতিশোধের আগুন ছিলো না। তিনি কেবল বলতেন—‘ক্ষমা, ক্ষমা এবং ক্ষমা।’

কোন হৃদয়ে জন্ম নেয় এমন অফুরন্ত দয়া? আমি তাঁর কেমন উম্মত হলাম যে—সামান্য অপমানে জ্বলে ওঠি, ক্ষোভে বুক ফেটে যায়। অথচ তিনি, রক্তমাখা পথে হেঁটে, নির্যাতন ও অবজ্ঞার ঝড় সয়ে, কেবল ভালোবাসার ডাক দিয়েছেন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ যেনো জ্বলজ্বলে প্রদীপ, মমতার আলোয় ভরে ওঠে পৃথিবী, যা ঘৃণার অন্ধকারকেও সহজেই ভেদ করে।

রাস্তার সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখারিকে দেখে হঠাৎ ভাবি—যদি তিনি এই শহরের রাস্তায় হাঁটতেন, থেমে কি যেতেন না সেই অনাহারী শিশুটির পাশে, যে ভাতের থালা হাতে কাঁদছে? ফুটপাথে শুয়ে থাকা বৃদ্ধের মাথায় কি রাখতেন না দয়ার হাত? মেট্রোরেলের ভিড়ে ঠাসা দেহের ভেতর দিয়ে হাঁটলে, কারও কাঁধে কি রাখতেন না ভরসার স্পর্শ?

আমার হৃদয় উত্তর দেয়—নিশ্চয়ই হ্যাঁ।

তাঁর দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে পারলে তিনি হয়তো একটিমাত্র প্রশ্ন করতেন—‘তুমি কি ভালোবাসতে শিখেছো? তুমি কি নিঃসঙ্গ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছো?’

আমি তখন লজ্জায় মাথা নত করতাম। শহুরে জীবন শিখিয়েছে প্রতিযোগিতা, হিংসা, আত্মঅহংকার। অথচ ভালোবাসার সেই সীমাহীন স্রোতকে ভুলে গেছি। রাতের গভীরতায় দাঁড়িয়ে তাঁর স্মৃতি থেকে টেনে আনি আলো। কানে বাজে হর্ন, বাতাসে ভেসে বেড়ায় ধোঁয়া, তবুও শুনতে পাই অদ্ভুত সুর—‘তাঁর নাম নাও, শান্তি আসবে।’

নিঃশব্দে উচ্চারণ করি—‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ।’ বারবার বলি। শব্দগুলো যেনো বাতাস ভেদ করে ওঠে যায় শহরের অন্ধকার আকাশে, ছড়িয়ে পড়ে তারা হয়ে।

কংক্রিটের দেয়ালে মরুর বালি জন্মাবে না, এখানে খেজুরগাছও ফুটবে না। কিন্তু বুকের ভেতরে গড়ে ওঠতে পারে অদ্ভুত মরুদ্যান—যদি তাঁর ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজে যাই।

তাঁর নাম উচ্চারণ করলে মনে হয় ধুলোমাখা পথ সবুজে ভরে ওঠছে, নর্দমার ধারে ফুটে ওঠছে অচেনা ফুল। হাসপাতালের করিডরে কান্নারত মায়ের চোখ শুকিয়ে যাচ্ছে, ফুটপাথে শুয়ে থাকা অনাথ শিশু হেসে ওঠছে।

তাঁর নামেই খুঁজে পাই একমাত্র আশ্রয়। তাঁর নামেই আবিষ্কার করি শান্তি, যা সব কোলাহল নিস্তব্ধ করে দেয়। তাঁর নামেই শিখি—ভালোবাসাই চূড়ান্ত সত্য, মমতাই শেষ মুক্তি। তাহলে আমি কেন থামবো? কেন নীরব থাকবো? আমি আবার বলি, অনন্তকাল ধরে বলি—

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ।
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ।
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ।

লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী , জামিয়া ইকরা বাংলাদেশ ; বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment