Home শিল্প সাহিত্যকিরগিজস্তানের ডায়েরি (২য় কিস্তি)

কিরগিজস্তানের ডায়েরি (২য় কিস্তি)

by MD JUNAYED SHEIKH

থার্টি ফাস্ট নাইটের আগের দিনের ঘটনা। কুরিয়ারের কাজ করার জন্য বাইক নিয়ে বের হলাম। অনেকক্ষণ কোনো অর্ডার নেই। আমাদের ক্যাম্পাসের এক পাশে গিয়ে বসে আছি। অবসর সময়টা পড়ার কাজে লাগাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি অর্ডার এলো। বাইক নিয়ে তড়িঘড়ি করে রওনা হলাম। কিছুদূর যেতেই পার্কিংয়ের পাশে হঠাৎ একটি গাড়ি এন্টিকেটর না দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিল। ধপাস করে পড়ে গেলাম। শরীরে তেমন চোট লাগেনি। কিন্তু বাইকের হাত ব্রেকের লিভার ভেঙে গেল। কিছুদিন আগে বরফে পড়ে ক্লাচের লিভার ও তার ছিঁড়ে যায়। ফলে দীর্ঘ এক দেড় মাস বাইক ফেলে রেখেছিলাম। এদেশে আমার বাইকের ক্লাচের ক্যাবল নেই।

বরফের দেশ হওয়ায় এদেশে বাইক জনপ্রিয় বাহন নয়। সর্বোচ্চ স্কুটারের দেখা মিলে। যারা মোটরসাইকেল এক্সপোর্ট ইমপোর্ট করে তাদের কাছেও গিয়েছে। ক্লাচের লিবার মিললেও ক্লাচ ক্যাবল কোথাও পাইনি। দেশ থেকে এক ওয়ার্কারের মাধ্যমে শাফিন ভাই ক্লাচ ক্যাবল আনার ব্যবস্থা করে দেন।

বাইকের শো-রুমে গিয়ে হাত ব্রেকের লিবার একটা লাগিয়ে নিই। ক্লাচ কেবল ছাড়া মোটামুটি অন্যান্য যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় এ দোকানে। এটি তালহা ভাইয়ের দোকান। কিরগিজ মানুষ হয়েও উর্দুতে অনর্গল কথা বলতে পারেন। তাবলীগের মানুষ। যুবক উদ্যোক্তা। ভাইয়ের একটা কথা আমার এখনো কানে বাজছে। এদেশে (কিরগিজস্তানে) বরকত বাকি আছে তাবলীগের মেহনতের কারণে।

তার দোকানের মিস্ত্রি পাকিস্তানের হামজা ভাই। মোটামুটি বাংলাদেশী ও পাকিস্তানি সবাই এই দোকানে আসে। উর্দু বোধগম্য হওয়ায় হামজা ভাই ও তালহা ভাইয়ের দোকানে সবাই ভিড় জমায়। এদেশের বিদেশে লোকদের মাঝে ৭০% পাকিস্তানি।

মোটরসাইকেলের মেরামতের দোকান এ দেশে অনেক কম। এর উপরে এরা অন্য ভাষাতো দূরের কথা ইংরেজিও বুঝেনা। এদেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পেশার লোকজনও ইংরেজি পারেনা। সেখানে সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম। এমনকি ওয়ান, টু , থ্রী– সংখ্যার উচ্চারণও ওরা জানে না যেটা আমাদের নার্সারি-প্লের বাচ্চারা জানে। কিরগিজ ভাষার পাশাপাশি এরা সবাই রুশ ভাষায় কথা বলে। এদের একাডেমিক সবকিছুতে রাশান ভাষার প্রভাব। মেডিসিন বিভাগেও রুশ ভাষায় শেখানো হয়। ইংরেজি লেশ মাত্র‌ও গন্ধ নেই।

কুরিয়ারের কাজটা আমার সাথে ভালো যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে পাঁচ দিনও কাজ করতে পারিনি, বিগত চার পাঁচ মাসে। একটার পর একটা সমস্যা লেগেই থাকে। আজকেও ৫০০/ ৬০০ সওম খরচ হয়ে গেল। কম টাকার অর্ডার পেয়েছি একটা। মনটা দমে যাচ্ছে। মেরামতের টাকা তো দূরের কথা তেলের খরচ‌ও উঠছে না।

বাইকে সব সময় আমি দরুদ পাঠে মগ্ন রাখি। দেশে থাকতেও আমি এই কাজ করতাম। বাইক চালানোর সময় অযথা চুপ না থেকে মুখে জিকির করতাম– দুরুদ শরীফ পড়তাম। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করত মনের ভিতর।

চলন্ত অবস্থায় হঠাৎ রাস্তার পাশে, এক ড্রেনে পড়ে গেলাম। একজন পথচারী ভদ্রলোক আমাকে উদ্ধার করলেন। বাইকের কোন কিছু হয়নি। আমিও বেঁচেছি। শোকর, আলহামদুলিল্লাহ।

কপালের কী অদৃষ্ট, আজকে একা একা দুইবার পড়ে গেলাম। নাহ , আরো সাবধান হতে হবে– ভাবতে ভাবতে কাজে মনোযোগ দিলাম। ইতিমধ্যে একটা অর্ডার কমপ্লিট করার পর আরেকটা অর্ডার এলো । লোকেশন বেশ খানিকটা দূরে; কিন্তু বেশ ভালো এমাউন্ট। কিছুদূর যাওয়ার পর মোচড়ানো কনক্রিটের রাস্তা। একে তো বরফের আচ্ছাদিত, পিচ্ছিল রাস্তা এর উপরে এবড়ো-খেবড়ো বিতিকিচ্ছিরি দশা। বাইকের ২ মিনিটের রাস্তা যেতে ১৫ মিনিট লেগে গেল। প্রধান সড়ক থেকে ভিতরে অনেক দূর চলে গেলাম। আশপাশে বড় বড় বিল্ডিংয়ের কাজ চলছে। সূর্য ডুবতেই থার্টি ফাস্ট নাইটের রাত। ফলে সবাই আজকে আগেভাগে ঘরে ফিরে গিয়েছে। বিজাতীয় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি কিভাবে মুসলিম মগজে প্রভাব ফেলেছে ভাবতে থাকি। রাস্তায় শুনশান নিরবতা। বড় এক অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে থামলাম। নিচতলায় রিসিপশনে গেলাম। মধ্য বয়সের দুজন মহিলা। দুইটি বোতল আর একটি ডাইরি এগিয়ে দিল।

মদের ব্যাপারে মুসনাদে আহমদের হাদিসটি মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল।
لَعَنَ اللهُ الْخَمْرَ وَلَعَنَ شَارِبَهَا وَسَاقِيَهَا وَعَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَبَائِعَهَا وَمُبْتَاعَهَا وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمُولَةَ إِلَيْهِ وَآكِلَ ثَمَنِهَا.

”আল্লাহ তাআলা লানত করেন- মদের উপর, লানত করেন তা পানকারী, পরিবেশনকারী, মদ প্রস্তুতকারী, যে প্রস্তুত করতে বলে, বিক্রেতা-ক্রেতা, বহনকারী, যার নিকট বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার মূল্য ভক্ষণকারী- সকলের উপর।”

ভদ্র মহিলাকে বললাম আমি এটা নিতে পারব না। চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল কেন? বললাম, পড়ে গেলে ভেঙ্গে যাবে যেহেতু কাঁচের বোতল। বলল, একটু অপেক্ষা কর। এই বলে কস্টিব প্যাঁচাতে লাগলো বোতলে, যেন পড়লে না ভাঙ্গে। মনে মনে দোয়া করতে লাগলাম, হে আল্লাহ, এই কোন পরীক্ষায় আমাকে ফেললে?
একদিকে অভাবের সময় ভালো এমাউন্টের অর্ডার। আরেক দিকে আল্লাহর রাসুলের অভিশাপ।
কী উত্তর দিব ভাবছিলাম। হঠাৎ মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল, ‘আজকে আমি দুইবার বাইক থেকে পড়ে গেলাম। রাস্তা বরফে ঢাকা। বাইক থেকে পড়লে যতই কস্টিব দিয়ে পেঁচানো হোক না কেন ভাঙবেই।’

মোক্ষম দাওয়াই। অর্ডার ক্যানসেল করে বের হয়ে গেলাম। কী এক নিদারুণ প্রশান্তিতে মন ভরে গেল, বোঝানোর মতো না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার ড্রেনে ফেলে জাহান্নামের ড্রেন থেকে রক্ষা করলেন বান্দাকে।

মন্দের ভিতরও আল্লাহ পাক কল্যাণ রেখেছেন। বাইক দুর্ঘটনার অজুহাতে হারাম কাজ থেকে রক্ষা পেলাম। সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment