নিঝুম রাত। চারপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কোথাও কেউ নেই। একা একা পথ চলছি।
আমি শহুরে নাগরিক। অনেকদিন পর আমার গ্রামের বাড়িতে এসেছি। ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিলাম মাগরিবের পরপর। যান্ত্রিক গোলযোগের দরুন দশটার পরিবর্তে
রাত দুইটা পাঁচ মিনিটে বাসটি আমাদের টোলপুর স্টেশনে এসে থামল।
বাস থেকে নেমেই যে যার মতো করে চলে গেল। আমি একা হয়ে গেলাম।
বুঝতে পারলাম, যে পথ ধরে বাড়িতে যাব সে পথে আমার সাথে যাওয়ার মত আর কেউ-ই নেই। কী আর করা।
একাই যেতে হবে।
পায়ে হাঁটা দূরের পথ। একা যেতে হবে সে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তবুও …
যাওয়ার পথে রানিগঞ্জ মেডিকেল সেন্টার। পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে অনেকদিন যাবত। জায়গাটি নিয়ে কিংবদন্তি চালু আছে। বিষয়টি কোনদিন পাত্তা দেই নি; কিন্তু আজ জায়গাটি নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম। চোখের সামনে ভাসমান।
যাইহোক, বাসায় এখনই পৌঁছাতে হবে তাই এসব চিন্তা বাদ দেই। জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি সহ অন্যান্য যা পারি– পড়তে পড়তে পথ চলা আরম্ভ করলাম।
হঠাৎ করেই আমার মনে হতে লাগল–চারপাশের পরিবেশ কেমন যেন উষ্ণ হয়ে উঠেছে। যত এগোই ততই অনুভব করি বিষয়টি। কেন জানি মনে হয়, কেউ একজন পিছন থেকে আমাকে অনুসরন করছে। শরীর ঘেমেনেয়ে উঠেছে। দূরে কোথাও আচমকা শেয়াল ডেকে ওঠে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেই।
চলতে চলতে কখন যে মেডিকেল সেন্টারের রাস্তায় ঢুকেছি , খেয়ালই করি নি। সৌর লাইটের আলোয় মেডিকেলের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এই বারান্দা নিয়ে রটেছে শতাধিক আশ্চর্য ঘটনা।
গ্রামের মানুষজন বলে, এই বারান্দা আসলে একটি অভিশপ্ত স্থান।
আর বলবেই না কেন, এই লম্বা টানা বারান্দাকে নিয়ে পশ্চিমপাড়ার খাজা ডালিমের সাথে যে ঘটনা ঘটেছিল সেটা আর কারো সাথে ঘটলে সেও এমনই মন্তব্য করতেন।
খাজার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা আসলেই খুবই আশ্চর্যজনক।
একদিন সন্ধ্যাবেলা। রাস্তাঘাটে লোকজনের আনাগোনা কমতে শুরু করেছে। খাজা ডালিম যখন বাজার করে মেডিকেলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই পা খোঁড়া এক জীর্ণশীর্ণ মানুষের সাথে দেখা। পায়ে ব্যান্ডেজ। ছোপ ছোপ রক্তের দাগ অন্য পায়ে।
মুখটি যথাসম্ভব আড়াল করে রেখেছে। লাইটের আলো হয়তো সহ্য করতে পারছে না।
সেই খোঁড়া লোকটি খাজা ডালিমের পথ আগলে দাঁড়িয়ে তার দারিদ্রতা উল্লেখপূর্বক শুকনো ম্যাড়ম্যাড়ে গলায় একটা লম্বা হাসি দিল। অযথা হাসি। খাজা ডালিমের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। তবুও খাজা ডালিম নিজেকে সংযত করে খোঁড়া লোকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন— কী চাও তুমি?
উত্তরে সে জানালো, তার চাই সামান্য কয়েকটি ঠাণ্ডা শীতল পানি মেশান ভাত।
আজব উত্তর।
খাজা ডালিম সাহস ধরে রাখলেন। এটা ফেল করলেই এ পেয়ে বসবে। তাছাড়া কথা বলতে বলতে দুয়েকটি লোকের উপস্থিতি বাড়বে– এই আশাও মনে প্রানে রাখছে।
খোঁড়া লোকটির গা থেকে বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোচ্ছে। গা গুলিয়ে আসছে।
খাজা ডালিম সাহস নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল, এই শীতের দিনে ঠাণ্ডা ভাত দিয়ে কি করবা ?
মাথা নিচু করে স্থির হয়ে আছে লোকটা। কোন সাড়াশব্দ নেই। কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। নীরবতা খাজা ডালিমের নিকট অসহ্য লাগে। জায়গাটি সামান্য কথায়ও যদি কোলাহলমুখর করে রাখা যায় , সেও স্বস্তি। খাজা ডালিম মরিয়া হয়ে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করল– এই শীতের দিনে ঠাণ্ডা ভাত দিয়ে কি করবা ?
আচমকা খোঁড়া লোকটি আকাশ বিদীর্ণ হাসি দিয়ে ব্যান্ডেজ খোলা শুরু করল। ঠাণ্ডা ভাত দিয়া রক্ত বন্ধ করমু। রক্ত পড়তেছে… রক্ত পড়তেছে …
খাজা ডালিম সম্বিৎ হারিয়ে পড়ে গেল।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তার মনে নেই। স্থানীয় কিছু লোক খাজা ডালিমকে মেডিকেল সেন্টারের বারান্দার সামনে অজ্ঞান অবস্থায় পায় এবং তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়।
খাজা ডালিমের ঘটনা চাউর হওয়ার পর থেকে গ্রামবাসীর মনে ভয় ঢুকেছে। ভয়ের পরিমাণ এতোটাই– দিনে দুপুরেও কেউ পা বাড়ায় না।
বিষয়গুলো নিয়ে যতই ভাবি, ততই গাঁ শিউরে উঠছে।
শুধু ভাবছি আর প্রার্থনা করছি। আয়াতুল কুরসি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার পড়া শুরু করছি। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ …