আহমদ সিরাজী
এম.জে. এফ নিউজ-31 জানুয়ারি
আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের এক আত্মীয়ের সাথে একদিন আমার প্রথম দেখা। অবশ্য আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের মাধ্যমে তাঁর সাথে আগেও ফোনে কথা হয়েছিলো ।মাওলানা মানুষ, ভালোই উর্দূ পারেন; পাকিস্তানি উস্তাযদের শিষ্য বলে কথা নিজেও পাকিস্তানে পড়েছিলেন।
এদেশে পাকিস্তানের রাইবেন্ডের প্রভাব অনেক। এখানকার মাদ্রাসাগুলো আমাদের দেওবন্দি ধারার। তবে রাইবেন্ড মাদ্রাসা এখানে বেশ প্রসিদ্ধ। তাঁরা রাইবেন্ডের পদ্ধতি অনুসরণ করে। কাফিয়া, শরহে বেকায়া, মেশকাত, দাওরা এভাবেই ক্লাসের বিন্যাস হুবহু দরসে নেজামির মতোই। আব্দুর রাজ্জাক ভাই পুরোদস্তুর তাবলীগী। স্ত্রী-পরিবার সকলেই পুরোদমে ধর্ম চর্চা করেন,পেশায় একজন গাড়ি মেকানিক। কাজের খাতিরে জার্মান, লিথুনিয়া, আফগানিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশে ছিলেন।
তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা ডেনজিয়া পিংয়ের জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। সেদিন কিরগিজস্তানের এক জাতীয় খাবারের টেবিলে আমাদেরকে আপ্যায়ন করান। আমাকে মাওলানা মুফতি জেনে হৃদয় থেকে মুহাব্বত করেন। বললাম, ভাই! আমি তো এদেশের ভাষা বুঝিনা, কোন কিছু চিনিনা। আপনি কষ্ট করে কম খরচের মধ্যে আমাকে একটি রুমের ব্যবস্থা করে দিন। পরক্ষণেই তিনি পরিবারের সাথে মশওয়ারা করে আমাকে বললেন আপনি আমার এখানেই থাকবেন। কোনো টাকা দেওয়া লাগবে না। বিনা টাকায় থাকতে আমি রাজি হচ্ছিলাম না। নাছোড়বান্দা বলা শুরু করলেন, আপনাকে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাখছি। এর প্রতিদান আমি আল্লাহর কাছে কামনা করি। প্রিয় ভাই এভাবেই আমাকে সহায়তা করেছেন।
এই ঘরে থাকতে বাংলা টাকায় প্রতি মাসে ২০/৩০ হাজার টাকা লেগে যেত। কিন্তু আল্লাহর এই নেক বান্দার উসিলায় থাকার খরচটি বেঁচে গেলো। শুধু তাই নয়, তাঁরা আমার খাবারের ব্যবস্থাও করেছেন। কিন্তু ২/৩ দিন খাবার ফিরিয়ে দিলাম। কারন, বাঙালি খাবার ছাড়া যে আমার গলা দিয়ে অন্য খাবার নামে না। এমনকি দেশেও চাইনিজ বা ফাস্টফুড জাতীয় খাবার খেতে পারতাম না। কিরগিজ খাবার তো অনেক দূরের বিষয়। আমি ভাইকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছি। তখন থেকে আমি নিজে রান্না করে খাওয়া শুরু করি।
২.
হাদীসে এসেছে- كل مؤمن كرجل واحد “সকল মুমিন ব্যক্তি যেনো একই ব্যক্তি” المسلم اخو المسلم “মুসলমান মুসলমানের ভাই” উল্লেখিত হাদীস সমূহের প্রতিফলন আমি এখানে এসে দেখতে পেলাম। এ দেশে তাবলীগ জামাআতের বদৌলতেই আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসা। অথচ আজ তাবলীগ জামাআতের বড্ড করুণ অবস্থা। দুঃখের এসব কথা চলছিলো আত্মীয়র সাথে এক পর্যায়ে আব্দুর রাজ্জাক ভাই বললেন, তিনি আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে গিয়ে সেখানকার লোকদের আমল দেখে খুব হতাশ।
আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের বাংলাদেশের মানুষ তুলনামূলকভাবে ধর্ম অনেক চর্চা করেন। তখন সাথে সাথেই আত্মীয় ভাইটি আমার কথার প্রতি উত্তরে বললেন, না, বরং বাংলাদেশে ইসলামের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে তাবলীগ নিয়ে দুই গ্রুপের যে কঠিন বিতর্ক এই বিষয়ে তাঁরাও জানেন। যদিও এখানের লোকেরা বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই অজ্ঞ। কিন্তু তাবলীগের কারণে পৃথিবীর সব প্রান্তে তাবলীগের কী অবস্থা এই ব্যাপারে তাঁরা ধারণা রাখেন। সেই হিসেবে বাংলাদেশের তাবলীগের বিষয়টাও তাঁদের সামনে আসে।
কিরগিজস্তানের লোকেরা পাকিস্তানের রাইবেন্ডকে মারকাজ মনে করে। ইন্ডিয়ার সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। সবাই আলেমদের পক্ষে। বাংলাদেশে মাওলানা সা’দ সাহেবের প্রতি যেই জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গী অন্যান্য দেশে আলমী শুরা ও আমির বিষয়ে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও এতোটা জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গী নেই। আসলে কথা হচ্ছে আমরা সবাই তো ভাই ভাই। আমি নিজেও যখন ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলাম, সেখানেও দেখলাম, যারা মাওলানা সা’দ সাহেবের বিপক্ষে তাদের মাঝেও এতোটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই যতোটা বাংলাদেশে রয়েছে।
আত্মীয় ভাইটি বললেন, ইসলামে এতটা বাড়াবাড়িও নেই যা বাংলাদেশের মানুষ করছে। এতে উল্টো ইসলামের ক্ষতি হচ্ছে। ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে-ই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত। আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান দেখবেন যারা মধ্য পন্থায় থাকে তারাই শ্রেষ্ঠ হয়। আল্লাহ তায়ালা মাওলানা ইলিয়াস সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে এতোটা কবুল করেছেন যে, তাঁর কাজকে মুজাদ্দিদানা কাজই বলা চলে।
আজকে কিরগিজস্তানের যেখানেই ধর্মের একটু প্রভাব রয়েছে প্রতিটি জায়গায়ই পুরোপুরি তাবলীগের প্রভাবের কারণেই। বিশকেকে অনেকগুলো মাদরাসা দেখলাম। আমার এক বন্ধু এ দেশের মাওলানা মুফতি। আমি তাঁর সাথে ওই মাদরাসায় গেলাম, যেখান থেকে তিনি ফারেগ হয়েছেন। সেখানে ৬০০ এর উপরে ছাত্র আছে। দাওরা হাদীসে ৫০জনের মতো ছাত্র। দেখে মনটা জুড়িয়ে গেলো।
এতো সুন্দর এদের নেজাম। দেখলেই স্বস্তি ফিরে আসে। মনে হচ্ছিলো দেওবন্দে প্রবেশ করেছি। উস্তাদদের আজমত। দরসে “قال قال رسول الله” এর সূর ধ্বনি। কিছুক্ষণ এই অসাধারণ অনুভূতি উপভোগ করার পর জিজ্ঞেস করলাম, এখানের ক্লাস ও নিয়মগুলোর তারতীব কী? তো শুনলাম আমাদের যেই বাংলাদেশে যেমন কাফিয়া, মেশকাত, দাওরা এরকমই এখানেও। এই নেজামেই চলছে। এদের মূলত নেজামটি এসেছে পাকিস্তানের রাইবেন্ড থেকে। অনেক আলেমগণ এখানে তাবলীগের কাজ করে যাচ্ছেন। এটি এতোটাই ফলপ্রসূ যে, পাকিস্তানের একজন আলেম এখানে দুটি মাদরাসা করেছেন।
প্রতিটিতেই ১হাজার করে ছাত্র। আর আমি বন্ধুর সাথে যেই মাদরাসায় গেলাম সেটি এখানের এক আলেমেরই মাদরাসা। তবে তিনি রাইবেন্ড থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। তাঁর মাদ্রাসাটির নাম “জামিয়া আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু”
৩
তাবলীগ জামাআতের বদৌলতেই আল্লাহ তাআলা বিশ্বের আনাচে কানাচে ইসলামের আলো পৌঁছাচ্ছেন। মাওলানা ইলিয়াস সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহির এটা ছিলো সংস্কারমূলক কাজ। আমাদের এনাটোমি ক্লাসের স্যার, কার্ডিওলোজির অনেক বড় একজন ডাক্তার। তিনি পাকিস্তানী। বিশকেকেই পড়াশোনা করেছেন।
একদিন স্যার বললেন, আমি এই শহরে অনেক বছর ধরে আছি। এখানে প্রথম দিকে জুমআর নামাযে কয়েকজন পাওয়াও মুশকিল ছিলো। অথচ আল্লাহর মেহেরবানী, তাবলীগ জামাআতের মেহনতে আজ মসজিদ ভরপুর হয়ে রাস্তার অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়।
একসময় লুটপাট, হানাহানি, মারামারিতে ভরপুর ছিলো। আজ আলহামদুলিল্লাহ এসব নেই। এগুলো সব তাবলীগী মেহনতের উসিলায় সম্ভব হয়েছে। একমাত্র ইসলামই যে কোনো খারাপ রূপকে পরিবর্তন করে দেয়। তাবলীগে নেই কোনো উগ্রতা। এজন্যই বিজাতীয়রা এটি বহুদিন ধরে টার্গেট করে রেখেছে। তাবলীগকে কলুষিত করার জন্য তারা অনেক চেষ্টা চালিয়েছে। যখন তারা ব্যর্থ হলো তখন ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলো। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এসকল ফিতনা থেকে হেফাজত করুন।
আমার বাসার পাশে একটি নামাজখানা আছে। এখানে লোকেরা পাঞ্জেগানা বা মসজিদকে নামাজখানা বলে। আমি ওখানে মাঝে মাঝে নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে তাঁরা ২/৩ জন মিলে তাবলীগের কাজ করে। একজনকে জিকিরে লাগিয়ে দেয়। আর ২জন কথাবার্তা শেষে দাওয়াতের কাজ করতে থাকে। এরপর তাঁরা বের হয়। তাবলীগের সকল কাজ সারা বিশ্বে একই নিয়মে একই ভঙ্গিতে চলে। তাই এটি বুঝতে সুবিধাজনক। তখন আমার মনে পড়লো, আল্লাহ তাআলা এই সামান্য সামান্য কাজে এতো বরকত দান করেছেন।
বলা হয়েছে, احب الأعمال الى الله ادومها و إن قل ছোটো ছোটো কাজও আল্লাহ তায়ালা কাছে অনেক প্রিয় যদি তা নিয়মিত হয়। আমার শায়েখ, আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব বলতেন, তুমি আল্লাহ আল্লাহ জিকিরে বাতাসকে ভারি করো। এই বাতাস যেই ঘরে পৌঁছবে সে ঘর থেকে আল্লাহর ওলী বের হবে। দেখা যাবে, কোনো খ্রিস্টানের ঘর থেকেও আল্লাহর ওলী বের হচ্ছে। আসলে এগুলোই তো মূলত আকাবিরদের তাজরিবা। তাঁদের রুহানিয়াত।
আজ ইসলাম তাত্ত্বিকতায় ঢুকে গিয়েছে। আসলে তো ইসলাম কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়। ইসলাম হলো একটি রূহের নাম। স্বভাবজাত ধর্ম। সহজ-সরল পথ। মধ্যম পন্থা, এতে নেই কোনো বাড়াবাড়ি নেই কোনো ছাড়াছাড়ি। যেখানে নেই উগ্রতা, হানাহানি ও মারামারি। আর আজকাল দেখা যায়, কিছু লোক দাঈ নাম দিয়ে মানুষকে উগ্রতার দিকে হাঁটাচ্ছে। আফসোস আফসোস!