মানুষ কখনোই একা চলতে পারে না। সমাজের ভিতর দিয়েই জীবন পার করতে হয়। কেউ চাইলেও একা চলা সম্ভব নয়। জন্মলগ্ন থেকেই ‘প্রয়োজন’ নামক বোঝা মাথায় নিয়েই দুনিয়াতে তার আগমন। এখান থেকে অন্যের মাথার বোঝা হয়েই ফিরতে হবে তাকে।
মানুষের প্রয়োজন কী কী? পৃথিবীর জটিলতম প্রশ্নগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি প্রশ্ন এটি।
বলতে পারি মানুষের প্রয়োজন অসীম। অসীম প্রয়োজন পূরণ করতে অসীম লোকের প্রয়োজন। প্রয়োজনের তাগিদেও তাকে শরণাপন্ন হতে হয় অন্যজনের। “ইন্নি জাইলিন ফিল আরদি খলিফাহ” আয়াতে কতই না সুন্দর করে ফুটে ওঠে বিষয়টি।
মানুষকে প্রতিনিধি করেই আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছেন। সংস্পর্শে যাওয়া ছাড়া প্রতিনিধি হয় কি করে? একজন প্রতিনিধির কাজই তো হলো ধারে ধারে ছুটে গিয়ে প্রতিনিধিত্ব করা। মানুষের উৎপত্তিটাই হলো সমাজবদ্ধ হয়ে থাকার জন্য। একজন মানুষ যখন মানুষের সাথে মিশে আল্লাহ তাআলার যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে তখনই তাকে পরিপূর্ণ মানব বলা হবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত মানুষের প্রতিটি কাজ হওয়া উচিত আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। বিছানায় শোয়াও প্রতিনিধির দায়িত্ব মাথায় নিয়ে। সকালেই মালিকের কাছে সমাগত হতে হবে। সালাত আদায়ের পর জমিনে ছড়িয়ে যেতে হবে। মোটকথা দুনিয়ার দেশে প্রতিনিধিকে যথাযথ দায়িত্ব আদায় করে নিজের নিবাসে ফিরতে হবে অচিরেই।
যথাযথ দায়িত্ব পূরণ হলে নিজের বরাদ্দ বাড়িতে ফিরে আসবে রাজার বেশে। দায়িত্বের কৃতি স্বরূপ মিলবে প্রণোদনা সম্মাননা। বলা হবে “যাও তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দিয়ে দিলাম”। জবাবদিহিতায় আটকা পড়লে খুয়াতে হবে বাবার শেষ ভিটাটাও। ঘোষণা হবে “ফাজূকুল আযাবা বিমা কানু ইয়াকসিবূন”। এই প্রতিনিধিত্ব তো মহান জিম্মাদারি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জাত যতো বড় তার প্রতিনিধিত্বও ততো বড়।
সূরা আল-হাশরে ইরশাদ হয়েছে, لَوۡ اَنۡزَلۡنَا ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ عَلٰی جَبَلٍ لَّرَاَیۡتَہٗ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنۡ خَشۡیَۃِ اللّٰہِ ؕ وَتِلۡکَ الۡاَمۡثَالُ نَضۡرِبُہَا لِلنَّاسِ لَعَلَّہُمۡ یَتَفَکَّرُوۡنَ
সূরা আল হাশর, ২১
একটি ক্ষুদ্র জীবের পক্ষে আদৌ কি সম্ভব এর যথাযথ আঞ্জাম দেওয়ার? কুরআনুল কারীমের ভার পৃথীবিকে ধরা রাখা পাহাড় পর্যন্ত অক্ষম। সেখানে কী করে সম্ভব একটা মানুষের পক্ষে এর ধারণ? সবকিছুর ভয় উবে যায় কাছে আসলে। দীর্ঘদিন কোনো কিছুর সংস্পর্শে থাকলে, প্রাক্টিক্যালি দেখতে দেখতে।
উড়োজাহাজ, জাহাজ বা ট্রেন দৈত্যাকৃতির এই বিশাল মেশিনারিও মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দীর্ঘদিন অভিজ্ঞ লোকের সান্নিধ্যে এসে প্র্যাকটিস ও শেখার তীব্র নেশায় তৈরি হয় একজন পারফেক্ট নাবিক, ক্যাপ্টেন ও চালক। পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই পারদর্শী ব্যক্তির সংস্রব প্রয়োজন।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে কখনো একে ধারণ করা সম্ভব নয়। এটি ইসলামের মেজাজও নয়। তাহলে কখনোই পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা নবী রাসূল পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করতেন না। ওহীর নাজিল রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে জীবনের শেষ পর্যন্তই ছিলো। ইন্তেকালের শেষ অবধি ইসলামের রূপরেখা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি হাতে কলমে দেখিয়ে গিয়েছেন।
নিজের সোহবতে রেখে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এক সোনালী কাফেলা। মরুর বুকে সবুজ শ্যামল এক বাগান। এই বাগানের একেকটি ফুল একেক ঘ্রাণ। প্রতিটি ফুলেই রসে গন্ধে টাইটম্বুর। মেইয়ারে হক; সত্যের মাপকাঠি। সেই বাগানের বীজ থেকে আরো বাগান এভাবে পৃথীবিময় ছড়িয়ে পড়ে ওহীর বাগান।
‘খয়রুল কুরুনী করনী, ছুম্মাল্লাযিনা ইয়ালু নাহুম ছুম্মাল্লিনা ইয়ালু নাহুম। নববী কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এই সোলানী শিকল। এই শিকলের স্বীকৃতি কেবলই প্রযোজ্য সোহবতের উপর। শুধু যুগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নচেৎ আবু লাহাব, উতবা ও শায়বাদেরকেও এই শিকলের প্রথম সারিতেই ধরা হতো।
মূলত সাহাবী তিনিই, যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহির সোহবত পেয়েছেন ও তাঁর শিক্ষায় নিজেকে আলোকিত করেছেন।
সাহাবীর সোহবত পেয়ে নিজেকে সেই আলোয় আলোকিত করেছেন, তিনিই তাবেয়ী। অনুরূপ তবে তাবেয়ীও। ইসলামে সোহবতের কোনো বিকল্প নেই। যেই সোহবত হতে হবে লিল্লাহি ওয়া লিরাসূলিহ।
এই সোহবতকেই দ্বীন মনে করা হতো সোনালী যুগের মনীষীগণ। পুঁথিগত বিদ্যাকে নয় কেবল।
খাইসামা ইবনে আবদুর রহমান রহমাতুল্লাহি আলাইহির গল্প আমরা সবাই জানি। তিনি বলেন, “আমি মদিনায় এসে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম, যেন তিনি আমাকে একজন নেককার সঙ্গী দান করেন। তখন তিনি আমাকে আবু হুরায়রার রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সাহচর্য দান করেন। আমি তার সঙ্গে বসবাস করতে থাকি।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহির কণ্ঠে কতই সুন্দর ভাষায় চিত্রিত হয়েছে, ‘মান আহাব্বা লিল্লাহ ওয়া আবগাজা লিল্লাহ, ওয়া আতা লিল্লাহ ওয়া মানাআ লিল্লাহ, ফাকাদ ইসতাকমালাল ঈমান; আমার রাগ ও ভালোবাসা এবং দান করা ও দান না করা, সবই হতে হবে আল্লাহ কেন্দ্রিক। তবেই আমার ঈমানের পূর্ণতা মিলবে। (সুনানে আবু দাউদ,৪৬৮১)
সহচর্যের ব্যাপারে মুসা বিন ঈসা আশ-শামি (রহ.) খুব সুন্দর বলেছেন।
“যখন আল্লাহ কোনো যুবকের মঙ্গল চান, তখন তিনি তাকে একজন নেককার ব্যক্তি দান করেন।”