প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে মক্তবে আরবী পড়ার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম। সে সুবাদে বাবা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করলেন।
প্রতিনিয়তই আমি বাবাকে বিরক্তি করতাম,বায়না ধরে বসতাম। তিনি আমার আগ্রহ আঁচ করতে পেরেছিলেন।
প্রাথমিক আরবী শিক্ষা লাভের জন্য প্রতিদিন পূর্বাহ্নে বাড়ীর পাশে মক্তবে যেতাম। রুটিনমাফিক প্রতিদিন এক থেকে দেড় ঘন্টা মক্তবে আরবী পড়তাম। বাকি সারাটা দিন পাড়ার অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সাথে খেলা-ধুলায় লিপ্ত থাকতাম।
বোধ হয় তখনই জীবনটা অনেক ভালো ছিল। মাঝে মাঝে এমনটাই মনে হতো। যদিও আমার ধারণা ভ্রান্ত ও ভুল ছিল। কখনো কোন কিছু নিয়ে ডিপ্রেশনে পড়তে হতো না। চাপ অনুভব করতাম না। মন চাহে জীবন পরিচালনা করতে পারতাম।
কখনো মানসপটে উঁকি মারতো, কখন বড় হব, লেখাপড়া করব? নিজেকে একটা ভালো অবস্থানে রাখবো? এগুলো মাথায় ঘুরপাক খেত প্রতিনিয়ত। কিন্তু পরক্ষণেই এমন চিন্তা স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যেত।
যাহোক, আমাদের বাড়ির সামনে অনতি দূরেই ছিল একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেই আমার অগ্রজদের সাথে লেখা-পড়ার হাতেখড়ি। মক্তব থেকে এসে প্রতিনিয়তই দেখতে পেতাম আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে ঐ স্কুলের শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। আমার বড় বোন ছিল ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। যে দৃশ্যাবলি আজও মনে পড়ে ছোট বেলায় ফেলে আসা হলুদ কয়েনের মতো। এগুলো প্রত্যক্ষ করে মূলত স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ জমে।
কিন্তু আগ্রহ থাকলেই কি আর হবে? তখনও আমি স্কুলে পড়ার মতো উপযুক্ত সময়ে উপনীত হয়নি। আমাকে শান্তনা দেয়ার জন্য আমার আত্মীয়দের কেউ কেউ আমাকে নিয়ে স্কুলে যেতো। স্যারদের সাথে কথা বলত আমার ভর্তির বিষয়ে। কিন্তু কথা বললে কি আর হবে?বয়স না হলে তো আর ভর্তি করানো যাবে না।
আমিও অপেক্ষা করছিলাম আমার উপযুক্ত বয়সের জন্য। কালের আবর্তনে
সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আমার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটল। আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত বয়সে পৌঁছলাম। কী আনন্দ !
পহেলা জানুয়ারী ২০০৯ ইং তারিখে সকাল সকাল প্রয়েজনীয় হাজত সেরে গোসল করে , নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয় স্কুল প্রাঙ্গণে।
সেদিনের একটি স্মৃতি আমার হৃদয় রাজ্যে আজও বাস করছে। তা হলো, সেদিন বাজারে গিয়েছিলাম বাবাকে নিয়ে এসে স্কুলে যেতে, তখন আমার গ্রামের প্বার্শবর্তী গ্রাম বোরগাঁওয়ের এক বৃদ্ধ লোক, যার যৌবন বিদায় হয়েছে বহু পূর্বে , উনার খুব ভালো তায়াল্লুক ছিল আমার বাবার সাথে। তাকে আমরা ভাই-বোন সবাই দাদা বলে ডাকতাম।তিনিও আমাদের আদর স্নেহে কাছে টানতেন।
তিনি তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কেন বাজারে আসছো নাতি? তাঁর প্রতি উত্তরে বললাম, দাদাজান, দোয়া চাই,আজ আমি আপনাদের নেক দোয়ায় ও আল্লাহর অশেষ কৃপা ও মেহেরবানিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছি। তখন পাশে বসে থাকা বাবাজান তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, আজকে তাকে স্কুলে ভর্তি করব তো, তাই আমাকে নিতে আসছে।
একথা শুনে তিনি আমাকে পাঁচ টাকার একটা নতুন নোট উপঢৌকন হিসেবে দিয়ে আমার তৈলাক্ত মাথায় তাঁর হাত বুলিয়ে কল্যাণের দোয়া করলেন। সাথে সাথে বেশ কিছু উপদেশও দিয়েছিলেন। যার প্রত্যেকটাই ছিল অর্থবহ। যে উপদেশগুলো আমার জীবনে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে।
আল্লাহ তায়া’লার কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করি, আল্লাহ তায়া’লা যেন তাঁকে তাঁর শান মোতাবেক প্রতিদান দেন। আমিন।
অতঃপর কালবিলম্ব না করে শ্রদ্ধেয় বাবার হাতটি ধরে চলে এলাম আমার নতুন বিদ্যাপীঠ প্রাঙনে। স্কুলের স্যারদের সাথে কথা বলে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম।
নতুন বছরের নতুন বই পেলাম। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে লাগলাম।