আব্বারা ছিলেন তিন ভাই। সবাই কর্মের সুবাদে নিজ নিজ পরিবার নিয়ে অনেকদিন যাবত আলাদা । দাদা দাদী তাদের আদরের ছোট পুত্রের সাথে থাকতেন। দাদা আমাদের বাসায় খুব একটা আসতেন না। তবে আমরা মাঝে মাঝে দাদা-দাদীকে দেখতে ছোট চাচার বাসায় বেড়াতে যেতাম।
দাদার সাথে আমার তেমন কোনো সুখস্মৃতি নেই, এতটুকুই । তবে দাদার প্রসঙ্গ যখন আসে, স্মৃতিরা তখন একেক করে হাজির হয়। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বের কথা। বার্ধক্য জনিত কারণে দাদা কয়েকমাস যাবত শয্যাসায়ী। দাদাকে আমরা দেখে আসলাম। অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছেন। কোনো ঔষধেই কাজ করছে না। হাল ছাড়তে বসেছে সবাই।
হঠাৎ ফোন এলো , গত দু’দিন যাবত দাদার অবস্থা উন্নতির দিকে যাচ্ছে । আল্লাহর শোকর আদায় করলাম। বাসার সবাই মিলে আজ রাতে দাদাকে দেখতে যাওয়ার কথা। অন্যান্য দিনের মতো আজকেও স্কুল থেকে এসে ছোটবোনকে নিয়ে বাসার গলিতে খেলছিলাম। সকাল গড়িয়ে কখন যে দুপুর হলো টেরই পেলাম না। চেতন ফিরলো যোহরের আযান কানে পড়তেই।
বাসার দিকে পা বাড়াতেই একটি বাইক আমাদের সামনে থামলো। পেছনের সিটে ছোট চাচা বসা। বাইকে বসা অবস্থায় একটি দুঃসংবাদ দিলেন। আমাদের প্রাণপ্রিয় দাদাজান আর নেই। ইন্নালিল্লাহি…। অদৃশ্য এক তীর এসে আটকে হৃদয়ে।
ছোট্ট বোনকে কোলে নিয়ে বাসার দিকে ছুটলাম। ঘরে ছোট ভাই শুয়ে ছিলো। আম্মা অফিস থেকে তখনও ফেরেনি। দরজা বন্ধ করে আমি কাঁদতে লাগলাম। আমার ছোট্ট অবুঝ বোনটিও আমার কান্না দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমাদের কান্নার আওয়াজ শুনে পাশের প্রতিবেশীরা দরজায় টোকা দিতে লাগলো। দরজা না খুলে দুই ভাইবোন অনবরত কেঁদেই যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আম্মা দুপুরের খবর খেতে এলেন।দরজার সামনের জটলা দেখে ঘাবড়ে গেলেন। আম্মার আওয়াজ পেতেই আমি দরজা খুলে দিলাম।
আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,আম্মু দাদা মারা গেছেন। ছোট চাচা এসে খবর দিয়ে গেলেন। আম্মা নীরব হয়ে বসে পরলেন। আম্মার দু’গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগলো। মোবাইল তখন এত সহজলভ্য ছিলনা। আব্বার মোবাইল ছিলোনা। আব্বা ছিলেন সিএনজি চালক। তাই আব্বার সন্ধান পাওয়া মুশকিল ছিলো।
আম্মা সেদিন এদিক সেদিক দৌঁড়ঝাপ করেলেন দাদার মৃত্যু-সংবাদটা বাবার কাছে পৌছানোর জন্য। আম্মা আমাদেরকে নিয়ে ছোট কাকার বাসায় গেলেন। বাসায় পৌছতেই কুরআনের তিলাওয়াত ভেসে আসলো কানে।
দাদাকে শেষ গোসল দেয়া হচ্ছে। দাদি শোকের ঘোরে বিলাপ করছিলেন। পাশে জড়ো হওয়া মহিলা আত্মীয়-স্বজনরাও তাল মিলিয়ে বিলাপ করে যাচ্ছিলো।
বিলাপ শরয়ী দৃষ্টিতে বিলাপ একটি নিন্দনীয় কাজ। এবং মৃতব্যক্তির জন্য আযাবের কারণ।এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও আমরা অসচেতন। নাসায়ী শরীফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: তার পিতা থেকে নবীজীর সূত্রে বর্ণনা করেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের ক্রন্দনের কারণে শাস্তি দেয়া হয়।
আছরের নামাজের পর দাদার জানাযা। কবর খনন কাজ তখনও চলমান। নামাজ শেষে অপেক্ষা করছিলাম। এদিকে আব্বা এখনও আসেনি। মাগরিবের আগে আগে দাদাকে খিলগাঁও গোরস্থানে দাফন করা হয়। দাদার কবর থেকে একটু দূরেই মসজিদ দেখে মনটা ভরে গেল। কবরে শুয়ে আযানের ঐশি বাণীর সুমধুর সুর শোনা দাদার আকাঙ্ক্ষা ছিলো কিনা জানিনা।আর এমন সৌভাগ্য কজনের কপালেই বা জুটে!
আমরা জানি, কাজী নজরুলের শেষ ইচ্ছা ছিল মসজিদের পাশে সমাধিস্থ হওয়ার।যা তিনি তার একটি গানে ব্যক্ত করেছেন,মসজিদেই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই। যেনো গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।
আমার অভাগা বাবা সেদিন কাজ থেকে ফিরলেন এশার নামাজের পর। আমাদের ব্যপারে প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসা করতেই দাদার মৃত্যু-সংবাদ শুনতে পান। মনের কোণে অজানা এক তীব্র ভয় আর ক্ষিণ আঁশা নিয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটে যান ছোট চাচার বাসায়। ছোট চাচার বাসায় পৌঁছে দেখেন সব শেষ। পিতার মুখটা শেষবারের মতো দেখা হলো না একটি বারের জন্য।
জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপটা সেদিন বাবাকে শিশুর মতো অঝোরে কাঁদতে বাধ্য করেছিল। কোন সান্তনাই যেন বাবার সেই গভীর ক্ষতের উপশম করতে পারছিল না।সেইদিনই প্রথম বাবাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। আজও আমি সেই কান্নার শব্দ শুনতে পাই।
হে আল্লাহ, আমার পিতামহকে তোমার মমতার চাদরে ঢেকে নাও। জায়গা দাও তোমার আরশের ছায়ায়।