হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রহ. বলেন, নেক ব্যক্তিদের আলোচনার সময় আল্লাহর রহমত নাযিল হয়। (জামিউ বয়ানিল ইলমি লিল খতীব, ২১৯৫) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. বলেন, আমি নেক ব্যক্তিদেরকে মহব্বত করি, যদিও আমি নেক নই; এই আশায় তাদের মহব্বতের বরকতে হয়ত আল্লাহ তাআলা আমাকেও নেক বানিয়ে দেবেন।
এই সমস্ত মহান ব্যক্তিদের কথায় প্রভাবিত হয়ে অধম গুনাহগার ‘একটি নক্ষত্র এবং মহীরূহের বিদায়’ নিয়ে কলম ধরেছি। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন ।
শায়খুল হাদীস মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ আকিল রহ. বর্তমান দুনিয়ার একজন মহীরূহ ও একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। এই মহামনীষীর জীবনী নিয়ে কিছু লিখার ইচ্ছা করেছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।
নাম : মুহাম্মদ আকিল
বাবার নাম : মাওলানা হাকীম মুহাম্মদ আইয়ূব
জন্ম : ৯ শাবান ১৩৫৫ হিজরী, মুতাবিক ১৫ অক্টোবর ১৯৩৭ ঈ.
শিক্ষাদীক্ষা : ১৯৪৭ ঈ. সালের জানুয়ারী মাসে দশ বছর বয়সে সাহারানপুরের জামে মসজিদে হিফজ শুরু করেন। ১৮ অক্টোবর ১৯৫০ ঈ. সালে হিফজ সমাপ্ত করেন। ১৯৫৩ ঈ. নিজেদের খান্দানী মসজিদ ‘মসজিদে হাকীমানে’ হিফজ শুনানোর আমল সমাপ্ত করেন।
শু্রু থেকে দাওরা এবং ফুনূন পর্যন্ত লেখাপড়া মাযাহেরুল উলূম সাহারানপুরে করেন। ১৩৮০ হিজরী মুতাবিক জানুয়ারী ১৯৬১ ঈ. সালে দাওরায়ে হাদীসের ক্লাস সমাপ্ত করেন। এরপর এক বছরে ‘ফুনূন’ ক্লাস সমাপ্ত করেন।
শিক্ষকবৃন্দ : সহীহ বুখারী পড়েন হযরত মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া রহ.-এর কাছে, মুসলিম শরীফ হযরত মাওলানা মনযুর আহমাদ খান সাহেব রহ.-এর কাছে, আবু দাউদ হযরত মাওলানা আসআদুল্লাহ রহ.-এর কাছে, জামে তিরমিযী এবং নাসায়ী শরীফ হযরত মাওলানা আমীর আহমাদ কান্ধলভী রহ.-এর কাছে পড়েন।
সাথীবর্গ : মাযাহে রুল উলূম সাহারানপুরের সাবেক শায়খুল হাদীস মাওলানা ইউনুস জৌনপুরী রহ., মাওলানা শুজাউদ্দীন হায়দারাবাদী, মাওলানা ইজতিবাউল হাসান কান্ধলভী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের সাথে তিনি পড়াশোনা করেন।
গভীর মুতালাআ, তীক্ষ্ণ মেধা শক্তি, সূক্ষ্ম বুদ্ধি, সুউচ্চ ইলমী ইস্তেদাদের কারণে শুরু থেকেই ছাত্ররা তাঁর দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সাহারানপুরে পড়াবস্থায়ই ছাত্ররা কিতাবের জটিল ও কঠিন জায়গাগুলো তাঁর কাছে বুঝে নিত। এ কথা স্বয়ং হযরত যাকারিয়া কান্ধলভী রহ. নিজের রোজনামচায় উল্লেখ করেছেন।
কর্মজীবন : জুমাদাস সানী ১৩৮১ হিজরী মুতাবিক ১৯৬১ ঈ. সালে বিনা বেতনে তিনি মাযাহে রুল ঊলূম সাহারানপুরে মুঈনে মুদাররিস তথা সহকারী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন। এক বছর পর নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান এবং শরহে তাহযীব এবং নুরুল আনওয়ার পাঠদানের সুযোগ পান।
১৩৮৬ হিজরী মুতাবিক ১৯৬৭ ঈ. সালে তাঁকে নিয়মতান্ত্রিক মাযাহিরুল উলূমের উস্তাদে হাদীস হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। প্রথম বছরেই তাকে আবু দাউদ শরীফ দরস প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আনুমানিক পঞ্চাশ বছর তিনি এ কিতাবের দরস প্রদান করেন।
জিল কাআদাহ ১৩৯০ হিজরী মুতাবিক ১৯৭১ ঈ. সালে মজলিসে শূরা তাঁকে মাযাহিরুল ঊলূমের সদরুল মুদাররিস হিসাবে নিযুক্ত করেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশি এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অত্যন্ত সুনামের সাথে আঞ্জাম দেওয়ার পর শারীরিক দূর্বলতা এবং মুতালাআর ব্যস্ততার কারণে গত দুই বছর আগে এই দায়িত্ব থেকে নিজেই অব্যাহতি নেন।
বায়আত ও ইজাযত : তাঁর বায়আত ও ইরশাদের সম্পর্ক ছিল হযরত শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া মুহাজিরে মাদানী রহ.-এর সাথে এবং হযরত থেকেই তিনি ইজাযতে বায়আত লাভ করেন।
তাসনীফ, তালীফ- কিতাবাদি : লেখালেখির প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে হযরত শায়খুল হাদীস রহ.-এর তাসনীফি কাজে তিনি সহযোগী ছিলেন। সুতরাং বিষয়বস্তু এবং বহস-আলোচনার সন্ধানের বিষয়টি তিনি হযরত রহ.-এর উপর ন্যস্ত করেছিলেন।
সেই সময়ে হযরত শায়খুল হাদীস রহ.-এর লামিউদ্দারারী ২য় খ-, ফাযায়েলে দরূদ শরীফ, জুযউ হাজ্জাতুল ওয়াদা’ ওয়া উমরাতুন্নবী, এবং আল আবওয়াব ওয়াত তারাজিম-এর কাজ চলমান ছিল। তিনি হযরতের সাথে উক্ত কাজগুলোতে মেহনত করেন এবং লম্বা সময় প্রদান করেন।
হযরত শায়খুল হাদীস রহ.-এর সাথে তার লেখালেখির কাজে লেগে থাকার কারণে তাঁর মেজায তবিয়তও লেখালেখির মেজায ও তবিয়ত হিসাবে গড়ে উঠে। তাই রবিউল আওয়াউল ১৩৯৮ হিজরী মুতাবিক ফেব্রম্নয়ারী ১৯৭৮ ঈ. আরবী ভাষায় ‘তারীফে ওয়াজিয আন জামিয়াতি মাযাহিরে উলূম’ নামে একটি কিতাব লিখেন।
হযরত মাওলানা গাঙ্গুহী রহ.-এর দরসে মুসলিমের একটি ‘ইফাদাত’ যা শায়খুল হাদীস রহ.-এর কাছে সংরক্ষিত ছিল। শায়খ রহ.-এর আকাঙ্খা মুতাবিক ঐ ইফাদাতের উপর মুহাম্মদ আকিল সাহেব রহ. হাশিয়া লিখে প্রায় ৬৪৪ পৃষ্ঠার একটি কিতাব ছাপেন।
মুকাদ্দামুতুল কাওকাবুদ্দুরিয়ি্যু, আলফায়যুস সামায়ী, আদ্দুররুল মানদুদ, মালফুযাতে হযরত শায়খ, মুখতাসার ফাযায়েলে দরূদ শরীফ ইত্যাদি কিতাব পাঠক সমাজে তাকে সমাদৃত করে তুলেছে।
বিবাহ শাদী ও সন্তানাদি : ১১ রজব ১৩৮১ হিজরী মুতাবিক ১৮ ডিসেম্বর ১৯৬১ ঈ. সালে তাঁর বিবাহ হযরত শায়খ রহ.-এর সাহেবজাদীর সাথে হযরত আকদাস রায়পুরী কুদ্দিসা সিররুহুর উপস্থিতিতে হযরতের কামরাতেই মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভী রহ. পড়ান।
হাজারেরও বেশি তাঁর ছাত্র রয়েছে, যারা তাঁর রূহানী সন্তান। সাথে সাথে তাঁর ১২ জন ঔরশজাত সন্তান রয়েছে। ছয়জন পুত্র সন্তান- যথাক্রমে মাওলানা মুহাম্মদ জাফর, মাওলানা মুহাম্মদ উমায়ের, মাওলানা মুহাম্মদ আদেল, মাওলানা মুহাম্মদ আসেম, মাওলানা মুহাম্মদ সানী, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম। তাঁর ছয়জন কন্যা সন্তান।
ইন্তেকাল ও সমাধি : শাবান মাসে স্বাভাবিক মামুল অনুযায়ী বুখারী শরীফ এবং মুসালসালাতের সবক শেষ করেন। অতঃপর বার্ধক্যজনিত রোগ এবং দুর্বলতা আরো বেড়ে গেল। চিকিৎসার জন্য হায়দারাবাদে চলে গেলেন। কিছুটা ্সস্তি ও সুস্থতা অনুভব করলে আবারও সাহারানপুরে চলে এলেন এবং সুবিধামতো মাদরাসায় আসা যাওয়া চালু ছিল। রমযান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফের আমলেরও যিম্মাদারী পালন করেন।
শাওয়ালের শুরু থেকে আবারও শারীরিক রোগ এবং দুর্বলতা বেড়ে গেল। মুতাআল্লিকীন এবং মুহিব্বীনে কেরামের পরামর্শে তাঁকে মীরাঠের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভর্তি করানো হয়। সেখানে অভিজ্ঞ ডাক্টারগণের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছিল। ২৮ শাওয়াল ১৪৪৬ হিজরী মুতাবিক ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ঈ. রোজ রবিবার ডাক্টারদের পরামর্শে তাঁকে হাসপাতাল থেকে নিজ বাড়ি সাহারানপুরে নিয়ে যাওয়া হলো।
অবশেষে ২৯ শাওয়াল ১৪৪৬ হিজরী মুতাবিক ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ঈ. রোজ সোমবার দুপুর পৌনে বারোটায় ইলমে হাদীসের এই আলোকজ্জ্বল নক্ষত্র চিরদিনের জন্য অস্তমিত হয়ে গেল। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
নিজেদের পারিবারিক কবরস্থান তাহেরী গার্ডেনে তাঁকে চির সমাহিত করা হয়।
আল্লাহ তাআলা স্বীয় রহমত দ্বারা তাঁকে সিক্ত করুন। মুতাআল্লিকীন, মুহিব্বীন, স্ত্রী-সন্তানকে সবরে জামীল ইখতিয়ার করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
(তথ্যসূত্র : মাসিক পত্রিকা: সাওয়ানিহী নুকূশ, মুখপত্র মাযাহিরে উলূম সাহারানপুর।)
মাওলানা আবদুল হালীম, শিক্ষক- নূরিয়া মাদরাসা মধ্যবাড্ডা।