বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দলটি তাদের ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল।
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের দাবির মুখে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিকে এখন জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সেজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
শনিবার রাতে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা শেষে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে।
- সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।
- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেস-সহ আওয়ামী লীগ এর যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে।
- পাশাপাশি, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এর আগে গত ২৩ অক্টোবর ‘সন্ত্রাসী’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এখন বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত একই আইনের আওতায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল শেখ হাসিনার সরকার পতনের তিন দিন পর ক্ষমতায় আসা মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।
উপদেষ্টা পরিষদের সভার এই সিদ্ধান্ত টেলিভিশনের লাইভে প্রচারিত হওয়া মাত্র শাহবাগ ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মোড়ে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
অনেকেই স্লোগান ধরেন, ‘এ মুহূর্তে খবর এল, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হল’।
জামায়াতে ইসলামী মধ্যরাতে রাজধানীর মগবাজার চৌরাস্তায় শোকরানা সমাবেশের আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল বের করেন বিভিন্ন হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা।

গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের খবরে শনিবার রাতে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে উল্লাস করেন আন্দোলনকারীরা।
গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিমঞ্চায়ন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। দলটির নেতা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
এর তিন দিনের মাথায় মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানের সময় হতাহতের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা হতে থাকে।
আওয়ামী লীগের সময়ে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল, সেই একই ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তার সহযোগীদের বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। অভ্যুত্থান দমাতে গিয়ে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের। তবে ওই দাবিতে জোরালো আন্দোলন শুরু হয় তিন দিন আগে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশত্যাগের খবর নিয়ে আলোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে সরকারপ্রধানের বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেয় একদল বিক্ষোভকারী। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করেন জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
শুক্রবার জুমার পর তারা মিন্টো রোডের প্রবেশ মুখে মঞ্চ বানিয়ে সেখানে সমাবেশ করেন। সেখান থেকে হাসনাত আবদুল্লাহ শাহবাগ অবরোধের ঘোষণা দেন।
সেদিন বিকাল থেকেই তারা টানা অবস্থান করছিলেন শাহবাগে। শনিবার বিকালে সেখানে গণজমায়েত করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করাসহ তিন দফা দাবি তারা তুলে ধরেন।
অবরোধ কর্মসূচিতে ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ, করতে হবে করতে হবে’, ‘লীগ ধর, জেলে ভর’, ‘ব্যান ব্যান, আওয়ামী লীগ’, ‘দফা এক দাবি এক, লীগ নট কাম ব্যাক’, ‘এক দুই তিন চার, চুপ্পু তুই গদি ছাড়’, ‘আওয়ামী লীগের নিবন্ধন, বাতিল কর করতে হবে’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ স্লোগান দিতে দেখা যায় তাদের।

হাসনাত আবদুল্লাহ সেখানে বলেন, “বাংলাদেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একটি ফ্যাসিবাদী শক্তি, আরেকটি বাংলাদেশি শক্তি। যারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চায় না তারা ফ্যাসিবাদী শক্তি, আর যারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চায়, তারা বাংলাদেশি শক্তি।”
পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে গণজমায়েত থেকে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে এক ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন।
হাসনাত বলেন, “ইন্টেরিম, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেন। আগামী এক ঘণ্টা সময় দিলাম। যদি এই এক ঘণ্টায় ঘোষণা না আসে, তাহলে আমরা ইন্টারকন্টিনেন্টালকে কেন্দ্র ধরে বাংলামোটর অবধি দখল করে নেব।”
এদিকে রাত সাড়ে ৮টার কিছু পরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক শুরু হয়, যা রাত ১০টা পর্যন্ত চলে।
এর মধ্যে শাহবাগে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের একটি অংশ দল বেঁধে এগিয়ে এসে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়ে অবস্থান নেন।
ওই মোড়ের আরেক সড়কে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে যাওয়ার পথে বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন।
রাত ১০টার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত জানান আসিফ নজরুল। তারপর শুরু হয় উল্লাস।

উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভার পর শনিবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
যেভাবে শাহবাগ থেকে আন্দোলন গড়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি আদায় করা হল, তার সঙ্গে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মিল দেখতে পাচ্ছেন অনেকে।
যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় এলে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু করেন একদল ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। তাদের দাবি ছিল, সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সে সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল না। শাহবাগে অবস্থান নিয়ে থাকা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের টানা আন্দোলনের মুখে সরকার শেষ পর্যন্ত আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ তৈরি করে।
রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় আসে সর্বোচ্চ আদালতে। কাদের মোল্লাসহ জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপি একজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে।

২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের শাহবাগ
সে সময় এক বছরের বেশি সময় ধরে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের টানা অবস্থান চলে।
জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা এবং দল হিসেবে তাদের বিচারের দাবিও তোলা হয় সেখান থেকে।
১১ বছর পর বৃহস্পতি থেকে শনিবার তারই বিপরীত মঞ্চায়ন দেখা গেল শাহবাগে, যেখানে জামায়াতের পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক দলগুলোও ছিল।
এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ শনিবার সন্ধ্যায় শাহবাগের গণ জমায়েত কর্মসূচিতে বলেন, “২০১৩ সালে শাহবাগের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ শুরু হয়েছে। আর এই শাহবাগ থেকে ফ্যাসিবাদের পতন হবে। আমাদের মত, পথ আলাদা হতে পারে; তবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে আমাদের মত, পথ এক। নমরুদের যেভাবে পতন হয়, ফেরাউনের যেভাবে পতন হয়, হাসিনারও পতন হয়।”

হাসিনা পারেননি, ‘ইন্টেরিম’ করছে
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল আইনে যে সংশোধনী আনা হয়, সেখানে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের সুযোগও রাখা হয়। কিন্তু সংগঠনের সাজা কী, সেটি উল্লেখ করা ছিল না।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে সে সময় আইনটি আবারও সংশোধন করবে বলেছিল শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু এক দশক ঝুলিয়ে রেখেও আওয়ামী লীগ সরকার তা করেনি।
এখন ট্রাইব্যুনাল আইনে সেই সংশোধনী এনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের পথ তৈরি করা হল, যে দাবিতে শাহবাগে আন্দোলন করছিল এনসিপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলো।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাদের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার অভিযোগে গত ১ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের সহ অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়।

সেই সঙ্গে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী জামায়াত এবং এর সকল অঙ্গ সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তার চার দিনের মাথায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৮ অগাস্ট জামায়াতের আবেদনে সেই নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়।
নয় মাসের মাথায় এখন সেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনেই নিষিদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত আওয়ামী লীগ নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে ৭৫ বছর অতিক্রম করেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটি বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল প্রায় সিকি শতাব্দী।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে এবং ২০০৭ সালে তার মেয়ে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছিল আওয়ামী লীগ।
সেসব কাটিয়ে উঠে দলটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরতে পারলেও এবার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল দলটি।