Home ইসলামপ্রবন্ধ । দারুল উলূম দেওবন্দ: ইখলাস কা তাজ মহল

প্রবন্ধ । দারুল উলূম দেওবন্দ: ইখলাস কা তাজ মহল

by MD JUNAYED SHEIKH
প্রবন্ধ । দারুল উলূম দেওবন্দ: ইখলাস কা তাজ মহল

ইসলামী বিশ্বে ইলমে হাদীস ও তাফসীরের এক প্রখ্যাত ও অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো দারুল উলূম দেওবন্দ। এটি আওলিয়া-এ-উম্মত ও মাশায়েখে হিন্দের এক পবিত্র আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং সমগ্র ভারতবর্ষের নিঃস্বার্থ ও নির্মোহ স্বাধীনতাকামী সাধকদের আবাসস্থল। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের মুসলমানদের কাছে “দারুল উলূম দেওবন্দ” বা “আযহারুল হিন্দ” নামে পরিচিত। উলামা ও সুলাহাগণ এটিকে “ইখলাস কা তাজ মহল” অর্থাৎ নিষ্ঠার মনোরম অট্টালিকা হিসেবে অভিহিত করেন।

যুগের শ্রেষ্ঠ আল্লাহওয়ালাগণ ঐশী ইঙ্গিত, পরম নিষ্ঠা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পূর্ণ ভরসা রেখে এই বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন। আজ এর শাখা-প্রশাখা সাত সমুদ্র পেরিয়ে বিস্তৃত হয়েছে এবং এর ফল ও ফুল দ্বারা গোটা ইসলামী বিশ্ব উপকৃত হচ্ছে। মূলত, এটি আমাদের পূর্বসূরী উলামা-এ-কেরামের ফয়েয ও বরকতের ফসল, যা তাঁদের তিরোধানের পরেও অব্যাহত রয়েছে।

দারুল উলূম দেওবন্দ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আদর্শ-দর্শনের সেই মহাসমুদ্র, যা নবী করীম (সাঃ)-এর হৃদয় থেকে প্রবাহিত হয়ে সাহাবা-এ-কেরামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং ভারতবর্ষে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ)-এর মাধ্যমে মাওলানা কাসেম নানুতভী (রহঃ), মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গূহী (রহঃ) ও মাওলানা ইয়াকূব নানুতভী (রহঃ)-এর সূত্রে দেওবন্দের পবিত্র ভূমিতে স্থানান্তরিত হয়েছে।

এর নহরগুলো শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং পৃথিবীর দিগ দিগন্তে বিস্তৃত হয়েছে। ইসলামী বিশ্বের জ্ঞানপিপাসুগণ বিভিন্ন সূত্রে এর জ্ঞান আহরণ করে নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণ করছেন।

দারুল উলূম দেওবন্দ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এক প্রজ্বলিত প্রদীপ, যার নীতি ও আদর্শের অনুসারীর সংখ্যা বিশ্বে প্রায় কোটি ছাড়িয়ে গেছে। তাঁরা সর্বদা এর জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বা মাসআলার সমাধানে যতক্ষণ না উলামায়ে দেওবন্দের ফতোয়া ও সমাধান পাওয়া যায়, ততক্ষণ তাঁরা আত্মিক শান্তি লাভ করেন না। কারণ, এখানে যে বিশ্বাসের প্রদীপ প্রজ্বলিত, তা মক্কা শরীফের প্রদীপেরই প্রতিচ্ছবি।

দারুল উলূম দেওবন্দ একটি এলহামী মাদরাসা। এর পাঠ্যক্রম নবী করীম (সাঃ)-এর শিক্ষা ও আদর্শের হুবহু অনুসরণ করে প্রণীত। যুগের শ্রেষ্ঠ আল্লাহওয়ালাগণ “তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহর উপর অকুন্ঠ আস্থা ও ভরসাকে পুঁজি করে এবং ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতকে ভিত্তি করে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের শাসনামলে ইসলামী ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি এবং ভারতবর্ষসহ সমগ্র বিশ্বে দ্বীনি শিক্ষাকে অক্ষুণ্ণ ও চিরন্তন করে রাখার লক্ষ্যেই এর জন্ম।

দারুল উলূম দেওবন্দ ইসলাম রক্ষার এক মজবুত দুর্গ। এর গ্র্যাজুয়েটগণ প্রত্যেকেই দ্বীন ও ইসলামের সৈনিক, যারা সর্বদা বাতিলের বিরুদ্ধে প্রস্তুত ও আত্মোৎসর্গিত। কোনো কিছুর বিনিময়ে তাঁরা বাতিলের সাথে আপস করেন না। কারণ, সকল প্রকার বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যই দারুল উলূম দেওবন্দের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে।

যখনই কোনো বাতিল ফিরকা ও ভ্রান্ত মতবাদ ইসলামের প্রকৃত রূপের উপর আঘাত হানার চেষ্টা করে, তখনই উলামায়ে দেওবন্দ অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে তার মোকাবিলা করেন। তাই আন্তর্জাতিক ও আন্তদেশীয় যেকোনো ভ্রান্ত মতবাদের উত্থানে সকলের দৃষ্টি দারুল উলূমের দিকে নিবদ্ধ থাকে। কারণ, তাঁরাই সেই ষড়যন্ত্র ও কুচক্রান্তের বিরুদ্ধে হিমালয় পর্বতের মতো অটল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তাদের সেই চক্রান্ত সুদৃঢ় পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।

বিশ্বের সর্বপ্রথম এই বিদ্যাপীঠ জনগণের চাঁদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর আগে সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও দ্বীনি মাদরাসা সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হতো। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম স্বতন্ত্রভাবে দারুল হাদীস ও দারুত তাফসীর (হাদীস ও তাফসীর ভবন) দারুল উলূমেই নির্মিত হয়। আর এটি উম্মুল মাদারিসও বটে। কারণ, ইংরেজদের শাসনামলে উপমহাদেশের সকল দ্বীনি মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়ার পর সর্বপ্রথম দারুল উলূম নামক নক্ষত্রই ধর্মীয় জ্ঞানের আলো বিতরণ করে।

দারুল উলূম দেওবন্দ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ এশিয়ার এক অনন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতি বছর প্রায় এক হাজার ছাত্র এখান থেকে হাদীস শরীফের কোর্স সম্পন্ন করে। প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ভারত এবং সারা বিশ্ব থেকে প্রায় দশ হাজার ছাত্র আগমন করে, যাদের মধ্যে মাত্র আটশতের কিছু বেশি ছাত্র ভর্তির সুযোগ পায়। আনন্দের বিষয় হলো, শুধু দাওরায়ে হাদীস থেকেই এক হাজারেরও বেশি আলেম হাদীস শরীফের সনদে ফযীলত লাভ করেন।

মূলত, দারুল উলূম দেওবন্দ শুধু একটি ধর্মীয় শিক্ষালয়, সাধারণ কলা অনুষদ, আধ্যাত্মিক সাধনাগার ও সুরম্য অট্টালিকার নাম নয়। বরং এটি এমন এক চিন্তা-দর্শন ও সংস্কার আন্দোলনের নাম, যা সারা বিশ্বে ইসলামকে প্রাণবন্ত ও সজীব রাখার জন্য এবং বিশেষভাবে এশিয়াতে ইসলামী শিক্ষা ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) পরিচালনা করেছিলেন। পরবর্তীতে দেওবন্দের মহান উলামায়ে কেরাম সেই মিশনকে আরও বেগবান ও সফল করেন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মুসলমান “কাফেলা-এ-ওয়ালী উল্লাহ”-তে শামিল হয়েছেন।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment