সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ
মাসনা, সুলাসা রুবায়া (দুই, তিন, চার বিয়ে) নিয়ে আবেগ নয়, বরং বাস্তবতা ও শরীয়্যাহ বিশ্লেষণ নিয়ে আসুন আলোচনা করি। এ বিষয়ে কুরআন হাদীস এবং ফোকাহাদের দলীল কি? শরীয়তের সিদ্ধান্তের সাথে সাথে ব্যাক্তি ও সামাজ জীবনে এর বাস্তবতা কী? ধরুন আপনার বয়স তিরিশ, আপনার বাবার বয়স ষাট। আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান এটা সমাজকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার দাবী আপনার!
কিন্তু আপনার বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে বা কোন অসহায় যুবতী মেয়েকে বিয়ে করে বৌ হিসেবে বাসায় নিয়ে আসবেন, তখন আপনি মানতে পারবেন তো? বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মেনে নেয়ার জন্য মাকে সুন্দর করে কুরআন হাদীস দিয়ে বুঝিয়ে বলতে পারবেন তো?
আবার ধরুন আপনার বোনের জামাই যদি বিয়ে করে আপনার বোনের ঘরে সতীন নিয়ে আসতে চান, তাহলে তার ঠ্যাং আস্ত রাখবেন তো? পা ভাইঙ্গা দিবেন না তো? কি পারবেন মেনে নিতে? অথবা দুলাভাইর বিয়ের আয়োজনে মনে প্রণে হাসিমুখে শরীক হতে ও উৎসাহের সাথে অংশ নিতে।
অথবা আপনার মেয়ের জামাই দ্বীতিয় বিয়ে করতে চান! আপনি কী মেয়ের ঘরে সতিন আনতে কনে দেখে দিতে পারবেন? পারবেন মেয়েকে সে তালিম তরবিয়ত ও শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে?মেয়ের সতিনকে গৃহে আনতে এই আয়োজনে মনেপ্রাণে শরিক হবেন? মন থেকে এই মানতে না পারাটি বাস্তবতা।
শরীয়ত ও সীরাত এটিকে নিরুৎসাহিত করেছে এই বাস্তবতা অনুধাবন করেই। ইসলাম কোন খঅহেশাত বা আবেগের ধর্ম নয়, বরং ইসলাম একটি পুনাঙ্গ বাস্তবধর্মী জীবনব্যবস্থা।
ইসলামে প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিয়ে করাকে জায়েজ করেছে এটা সত্য কথা। কিন্তু একাধিক বিয়েকে কখনো উৎসাহিত করে নি। বরং নিরুৎসাহিত করেছে বারবার। কেন করেছে? কুরআন, হাদীস, সীরাতে সাহাবা ও সলফে সালেহীনদের জীবন চরিত্র গভীরভাবে অধ্যায়ন করলে এটি স্পষ্ট প্রতিয়মান হয়। বহুবিবাহের ফজিলতের চেয়ে শরীয়ত মাসআলা বেশি বলে শর্তারূপ করেছে।
তালাকের মাসাআলার মতোই একাধিক বিবাহের মাসআলা। এখানে শরীয়ত সুযোগ রেখেছে। প্রয়োজনে তা কাজে লাগাতে পারবে। কিন্তু এটিকে অপছন্দ করেছে। নিরুৎসাহিত করেছে। এটি নিয়ে মার্কেটিং করা, বিয়ে বিয়ে খেলা করা। মজা মস্তি করা! নিজের যৌনলালসা পুরণের জন্য বারবার বিয়ে করা এসব ইসলাম পছন্দ করে নি। পুরুষের খাহেশাত পুরা করার জন্য নয়, বরং ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নারীর নিরাপত্তার জন্য এর সুযোগ রাখা হয়েছে।
ইদানিংকালে নেট দুনিয়া স্বল্প শিক্ষিত ও অতিউৎসাহী কিছু নেটিজন এটিকে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রমোট করছেন দেখে অবাক হতে হয়ে। যদিও একাধিক বিয়ের পাল্লায় পরে তাদের জীবনই অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরামের আমলে একাধিক বিয়েকে উৎসাহিত করার ঘটনা খোঁজে পাওয়া যায় না। তারা যা করেছিলেন সেটি প্রয়োজনের তাগিদে, নারীর নিরাপত্তা ও শরীয়াহ প্রয়েজনে, নিজের যৌন চাহিদা বা খায়েশাত পুরণ করার জন্য কখনো নয়।
কুরআনের যে আয়াত দিয়ে বহু বিহাহকে জায়েজ করা হয়েছে, এবং এর দলিল পেশ করা হয়, সেই আয়াতেই স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয় বিবাহকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
কারণ একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের সবার মধ্যে সমতা বিধান করা স্বামীর কর্তব্য। কারো ক্ষেত্রে কম বেশি হলে শেষ বিচারের দিন স্বামীকে জবাবদিহি করতে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে।
২
“মাসনা, সুলাসা, রুবা’আ” — এই শব্দগুলো এসেছে সূরা আন্-নিসা, আয়াত ৩ থেকে। আয়াতটি হলো:> فَانكِحُوا مَا طَابَ لَكُم مِّنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً…
(সূরা আন্-নিসা: ৩)
অনুবাদ:“তবে তোমাদের মধ্যে যারা এতিম নারীদের প্রতি ইনসাফ করতে না পারার আশঙ্কা করে, তারা যেসব নারী ভালো লাগে, তাদের মধ্যে থেকে দু’জন, তিনজন অথবা চারজনকে বিয়ে করো। আর যদি আশঙ্কা করো যে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে একজনই যথেষ্ট…”
আল্লাহর নিরুৎসাহিত করার দিক:
আয়াতটির শুরুতে একাধিক বিয়ের অনুমতি দেওয়া হলেও, এর মধ্যে কিছু গভীর দিকনির্দেশনা আছে:
১. ইনসাফের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে:
“فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً” — যদি মনে হয় যে একাধিক স্ত্রীর মধ্যে ন্যায়বিচার রাখতে পারবে না, তবে একজনই যথেষ্ট।
এটা একপ্রকার সতর্কতা ও নিরুৎসাহন। কারণ আল্লাহ জানেন, মানুষের পক্ষে একাধিক স্ত্রীর মাঝে সমান ব্যবহার করা খুবই কঠিন।
২. আল্লাহ অন্য এক আয়াতে আরো কঠোরভাবে বলেন:
> “وَلَن تَسْتَطِيعُوا أَن تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ”
“তোমরা কখনোই নারীদের মধ্যে পূর্ণ ন্যায়বিচার করতে পারবে না, যতই চেষ্টা করো না কেন” (সূরা আন্-নিসা: ১২৯)
এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, পূর্ণ ন্যায়বিচার প্রায় অসম্ভব, তাই বাস্তবে একজন স্ত্রীকেই সর্বোত্তম ও নিরাপদ বিবেচনা করা হয়েছে।
৩. নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিরুৎসাহন:
ইসলাম বহুবিবাহকে উৎসাহ দেয়নি, বরং প্রয়োজনে অনুমতি দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধ বিধ্বস্ত সমাজে বিধবা ও এতিম নারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এ বিধান এসেছে।
৪. নবী করিম (সা.) নিজেও বলেন:
“যে ব্যক্তি একাধিক স্ত্রীকে বিবাহ করে এবং তাদের মাঝে ন্যায়বিচার করে না, কেয়ামতের দিনে সে এমন অবস্থায় আসবে যে, তার শরীরের এক পাশ ঝুলে থাকবে।”
(তিরমিজি, আবু দাউদ)
“মাসনা, সুলাসা, রুবা’আ” শব্দগুলো দ্বারা বহুবিবাহের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে (সর্বোচ্চ ৪ জন), কিন্তু সেই সঙ্গে ন্যায়বিচারের কঠোর শর্ত দিয়ে এমনভাবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে যাতে এটি সাধারণভাবে নিরুৎসাহিত হয়।
তাই বলা যায়, আল্লাহ বহুবিবাহকে বৈধ করেছেন কিন্তু উৎসাহ দেননি; বরং তিনি ন্যায়বিচার করতে না পারলে একজনই যথেষ্ট — এই বলে নিরুৎসাহন করেছেন।
আল্লাহ বলেছেন “একাধিক স্ত্রী থাকলে তোমরা হয়তো একজনের দিকে বেশি ঝুঁকে যেতে পার; তাই তোমরা একজন স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করো।”
এখানে সয়ং আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে বলছেন, “তোমরা একজন স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করো।” সেখানে বহু বিবাহের জন্য সর্ব সাধারণের মাঝে মার্কেটিং করা মূলত মহান রবের ইচ্ছার বিরোধী কাজ। আল্লাহ বন্দাকে নিরুৎসাহিত করে বলছেন “তোমরা সমতা রক্ষা করতে পারবে না।”
৩
সুরায়ে নিসার একাধিক বিয়ের এ আয়াতটি নাযিল হয় ওহুদ যুদ্ধের পরক্ষণেই। ওহুদ যুদ্ধে অনেক মুসলিম শহীদ হন। তাদের স্ত্রী ও সন্তানেরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। তাদের খাদ্য, আশ্রয় ও পারিবারিক পরিবেশের প্রয়োজন ছিল। এ কারণে তাদেরকে বিভিন্নজনের তত্ত্বাবধানে রাখা হলো। বুখারী শরীফে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, জনৈক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে একটি এতিম মেয়ে ছিল। সে ব্যক্তির একটি বাগান ছিল, যার মধ্যে উক্ত এতিম বালিকাটিরও অংশ ছিল। সে ব্যক্তি উক্ত মেয়েটিকে বিয়ে করে নিল এবং নিজের পক্ষ থেকে ‘দেন মোহর’ আদায় তো করলোই না, বরং বাগানে মেয়েটির যে অংশ ছিল তাও সে আত্মসাৎ করে নিল। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়।
এ আয়াতটি সর্তকতার সাথে পড়লে কয়েকটি ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে আসে।
১) বহুবিবাহ মুসলমানদের জন্য ‘অত্যাবশ্যক’ (ফরজ) বা পছন্দনীয় (মুস্তাহাব) কিছু নয়। বিশেষ কিছু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুযোগ মাত্র।
২) একের অধিক বিয়ে শর্তযুক্ত। শর্তপূরণের সাপেক্ষেই এটি হালাল হয়।
৩) সমতা বিধান না করতে পারলে একটি বিবাহে সন্তুষ্ট থাকতে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমতা বিধান না করতে পারলে একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ।
৪) সমতা বিধান ফরজ।
৫) ইসলাম বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করে নি তবে নিরুৎসাহিত করেছে।
আবার এটি বলেছেন, “আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনেই সন্তুষ্ট থাক।” (সূরা নিসা : ৩)
অর্থাৎ ঢালাওভাবে সবপুরুষের জন্য সব পরিস্থিতিতে বহুবিবাহকে আল্লাহ জায়েয করেন নি। আমাদের দেশে অনেকের এ ভুল ধারণা রয়েছে যে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সওয়াবের কাজ। ধারণাটি ভুল। বিশেষ অবস্থায় শর্তসাপেক্ষে এটি মুবাহ মাত্র। অপ্রয়োজনে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। (দ্রষ্টব্য- নিসা : ৩)
বহুবিবাহের আয়াত নাজিল হয়েছিলো উহুদ যুদ্ধের পর। মাসনা থেকে আয়াত শুরু হওয়ার কারণ ও পেক্ষপট এটি। আয়াতের শানে নুযুল পড়ুন। যখন বিপুল পরিমাণ মুসলিম পুরুষ সৈন্য মারা গেলেন। নারীরা তখন কেউ বিধবা হল, কেউ এতীম হল।স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের সংখ্যা কমে গেলো। বহুবিবাহ ছাড়া সব মেয়ের জন্য স্বামীর ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিলো না। এপেক্ষাপটে আল্লাহ জায়েজ ঘোষনা করেছেন কিন্তু শর্ত ও নিরুৎসাহিতের সাথে। আর এখানে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও সম্ভ্রম সুরক্ষাই মূল উদ্দেশ্য। (বিস্তারিত দেখুন : তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন : ২/২৮৬-২৯৫, আনওয়ারুল বয়ান : ২/২৩৫, তাফসির ফি জিলালিল কোরআন : ১/৫৭৭-৫৮৩)।
সুতারাং দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় বিয়ের হুকুম এসেছিল নারীর স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে, পুরুষের খায়েশ মিটানোর জন্য নয়। সেসব নারীদের পেক্ষিতে এই আয়াত যারা বিধবা ও অসহায়। তাদের আশ্রয়ের জন্য। তাদের ও তাদের সন্তানের নিরাপত্তা ও হেফাজতের জন্য। আজকের যেসব ইসলামপন্থী তরুণ মাসনার আওয়াজ তুলছেন, তারা কী কখনো এমন অসহায় নারীদের নিয়ে ভাবছেন? তাদের প্রয়োজনে বিবাহ করে দায়িত্ব নিচ্ছেন? বরং অধিকাংশই শর্তের বাহিরে কেবল নিজের মনোরঞ্জন মেটানোর জন্য এসব বিষয় ভাইরাল করছেন। আবেগ নয়, আসুন শরীয়াহ বাস্তবতা অনুধাবন করে বহু বিবাহ কেন জায়েজ সে পেক্ষাপট অনুধাবনের চেষ্টা করি।
৪
যারা একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেন তারা আল্লাহর দেয়া শর্ত ‘সমব্যবহার’ অনেক ক্ষেত্রেই করেন না, এক্ষেত্রে সমব্যবহার হলো –
একই মানের বাসস্থান।
একই মানের খাদ্য।
একই মানের পোশাক।
একই মানের সুযোগ সুবিধা (যেমন চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি)।
সমপরিমাণ সময় দান। রাসূল (স.) তার অল্পবয়স্কা স্ত্রী (আয়েশা (রা.)) এর জন্য যতদিন বরাদ্দ করেছিলেন বৃদ্ধা স্ত্রী সাওদা এর জন্যও ততদিনই বরাদ্দ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর নিজের দিনটি আয়েশা (রা.)-কে দিয়ে দেন। কাজেই যারা এরূপ সমব্যবহার করতে পারবে না তাদের জন্য একাধিক বিবাহ হালাল নয় বরং এক স্ত্রী গ্রহণ ফরজ। (সূরা নিসা : ৩)
রাসূলুল্লাহ (স.)-এর একাধিক স্ত্রী বর্তমান বিদ্যমান ছিল। আর তিনি ছিলেন আদল ও ইনসাফের মূর্ত প্রতীক। সকল স্ত্রীকে সমান মর্যাদা দান করতেন। স্ত্রীদের জন্য যতটুকু সময় ব্যয় করতেন, তা সকলের জন্য সমানভাবে ভাগ করতেন। এভাবে সাওদাসহ আরো কয়েকজন স্ত্রী সমানভাবে রাসূলুল্লাহ (স.)-এর আরাম ও প্রশান্তি লাভের সময়ের ভাগ পেতেন। কিন্তু মূলতঃ তাঁদের বয়সের কারণে তারা রাসূল (স.)-কে প্রশান্তি দিতে অক্ষম ছিলেন। স্বেচ্ছায় নিজের অধিকার সতীন আয়েশা (রা.) এর অনুকূলে ছেড়ে দিয়ে রাসূল (স.)-কে দায়মুক্ত করেন।
৫
নবীজির (ﷺ) বাস্তব জীবনে বহুবিবাহ: প্রয়োজন ও দায়িত্ববোধের প্রেক্ষাপট
রাসূলুল্লাহ ﷺ ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছর বয়সী বিবি খাদিজা (রা.)-কে বিয়ে করেন এবং তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আর কোনো স্ত্রী গ্রহণ করেননি। বিবি খাদিজা (রা.)-এর ইন্তিকালের পর নবীজির ﷺ একাধিক বিবাহ হয়, কিন্তু সেগুলো:
এছাড়া রাসুল সা. এর সকল বিবাহই ছিল কোন একটি বিষয়কে সামনে রেখে এবং যা নবীর জন্য খাস ছিল। যেমন
রাজনৈতিক কূটনীতি (যেমন: জুয়াইরিয়া ও উম্মে হাবীবা),
সামাজিক পুনর্বাসন (যেমন: সাবিহা, যিনি বিধবা ছিলেন),
ইতিহাস সংরক্ষণ ও নারীদের মাঝে দ্বীন প্রচার (যেমন: আয়িশা রা.)—এসব উদ্দেশ্যেই ছিল।
কোনো বিবাহই কামনাকেন্দ্রিক বা বিলাসিতা-নির্ভর ছিল না।
উপরোক্ত দলীল থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, বহু বিবাহ শর্ত সাপেক্ষে জায়েয কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিনা প্রযোজনে খাহেশাতে বা সমতা রক্ষা করতে না পারলে বহু বিবাহকে নিরুৎসাহিতই বেশী করা হয়েছে।
বহুবিবাহের ইস্যুটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা ইস্যু। ইসলামে একের অধিক বিবাহকে প্রয়োজনে জায়েজ করা হয়েছে এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ বিয়ের অনুমতি দেয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে বা প্রাসঙ্গিক শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা কম হয়। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন-চরিত্র ও সীরাতের সাথে এটিকে না মিলিয়েই আম আওয়াজ তুলতে চাই।
নবিজী খাদিজা রাযি এর জীবদ্দশায় কোন নারীকে বিয়ে করেন নি। এটিও একটি সুন্নত। দীর্ঘ ২৪ বছর সংসার করেছেন। আপনি আগে ২৪ বছর একজন নিয়ে সংসার করুন তার পরে দ্বিতীয় বিয়ের সুন্নত পালন করুন। এটিতো নবিজীর শিক্ষা।
হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজা (রাযি:) ইন্তেকালের পরবর্তী জীবনের বিয়েগুলো ছিল কোনটা সামাজিক কারণে, কোনটা রাজনৈতিক কারণে,কোনটা ধর্মীয় কারণে। নবিজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজাতুল কুবরা রাযি: ছাড়া সকল স্ত্রীদের আল্লাহর নির্দেশে, ইসলামের প্রয়োজনে বিয়ে করেছিলেন।
যেমন, পালিত পুত্রের স্ত্রীর সাথে দেখা দেয়া নাজায়েজ এবং বিধবা হলে বা ডিভোর্স হলে বিয়ে করা জায়েয; এই নিয়ম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিজেই তালাকের পর পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেছিলেন। আম্মাজান আয়েশার সাথে তার বিয়ের পয়গাম সয়ং আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছিলেন। কারণ তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। মূলত অল্পবয়সে মানুষের স্মৃতিশক্তি ভালো থাকে। কাজেও দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর উম্মুল মোমেনীন আয়েশা (রা:) সর্বোচ্চসংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হযরত আলী (রাযি:) রাসূলের নিকট দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি চাইলে তিনি বলেছিলেন “যে আমার ফাতিমাকে কষ্ট দেয় সে যেন আমাকেই কষ্ট দিল।”অর্থাৎ তিনি নিজেও প্রথম স্ত্রীর জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিয়েকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
রাসুলের পবিত্র স্ত্রীগন ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের জন্য নির্নাচিত ও সম্মানীত। এই মর্যাদাবান উম্মাহাতুল মুমিনিন মধ্যেও সতিনদের সাথে ঝগড়া, মান অভিমান এর কথা হাদীসে এসেছে। স্ত্রীদের এসব আচরণে নবিজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কষ্ট পেয়ে দীর্ঘ দিন আম্মাজানদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এনিয়ে আল্লাহপাক কুরআনের আয়াত নাজিল করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানবের সীরাতের এসব ঘটনা উম্মতের জন্য কী শিক্ষা দেয়?
এছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. -এর বহু বিবাহের মাঝে সুপ্ত ছিলো বহু প্রজ্ঞা। আরশের স্রষ্টা আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মহৎ কাজ সম্পাদন করেছেন। আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ততক্ষণ আমি কোনো নারীকে বিবাহ করিনি এবং আমার মেয়েদেরকে অন্য কারো কাছে বিবাহ দেইনি যতক্ষণ না আমার প্রভুর পক্ষ থেকে জিবরাঈল আ. বিবাহের আদেশ সম্বলিত বার্তা না এনেছেন। [উয়ুনুল আছার – ২/৩০০, শরহে মাওয়াহিব – ৩/২১৯]
আপনার আলোচনার বিষয়বস্তু অত্যন্ত গভীর, গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। আপনি যে পয়েন্টগুলো তুলে ধরেছেন—বিশেষত, নবী করিম (সা.)-এর জীবনের দৃষ্টান্ত, হাদীসের বাণী ও ফাতেমা (রা.)–কে কেন্দ্র করে বহুবিবাহ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি—তা এই বিষয়ের ফিকহি ও মানবিক দিককে স্পষ্ট করে তোলে।
১. দুই স্ত্রীকে সমতায় না রাখার পরিণাম
> مَنْ كَانَتْ لَهُ امْرَأَتَانِ، فَمَالَ إِلَى إِحْدَاهُمَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَشِقُّهُ مَائِلٌ
رواه أبو داود (২১৩৩)، والنسائي (৩৯৪২)، وابن ماجه (১৯৬৯)، وأحمد (2/347)، والحاكم (২/১৮৬)، وابن حبان (৪১৭৭)
অনুবাদ: “যার দুইজন স্ত্রী থাকবে, আর সে এক জনের প্রতি ঝুঁকে পড়বে (অন্যজনকে অবহেলা করবে), সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে—তার শরীরের এক পাশ ঝুলে থাকবে।”
ব্যাখ্যা:
এই হাদীসটি স্পষ্ট করে দেয় যে, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা ফরজ; অন্যথায় তা কিয়ামতের ভয়াবহ শাস্তির কারণ হবে।
২. আলী (রা.)-এর ফাতেমা (রা.)-কে তালাক না দিলে দ্বিতীয় বিবাহে নিষেধাজ্ঞা
> عَنْ الْمِسْوَرِ بْنِ مَخْرَمَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ، يَقُولُ:
“وَإِنِّي وَاللَّهِ لَا أُحِلُّ حَرَامًا، وَلَا أُحَرِّمُ حَلَالًا، وَلَكِنْ وَاللَّهِ لَا تَجْتَمِعُ بِنْتُ رَسُولِ اللَّهِ وَبِنْتُ عَدُوِّ اللَّهِ فِي مَكَانٍ وَاحِدٍ أَبَدًا”
رواه البخاري (৫২৩০)، ومسلم (২৪৪৯)
আর এক বর্ণনায় আছে:
> “فاطمة بَضْعَةٌ مني، يُؤذيني ما آذاها، ويَسوءني ما ساءها.”
رواه البخاري (৩৭২৯)، ومسلم (২৪৪৯)
অনুবাদ:”ফাতেমা আমার অঙ্গের অংশ। যে জিনিস তাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকেও কষ্ট দেয়। আমি অপছন্দ করি এমন কিছু, যা সে অপছন্দ করে। আমি আলীকে অনুমতি দিইনি, যতক্ষণ না সে ফাতেমাকে তালাক দেয়।”
ব্যাখ্যা: এখানে নবীজি (সা.)-এর ব্যক্তিগত অবস্থান বহুবিবাহের বিরুদ্ধে নয়, বরং মানবিক, মানসিক ও পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে ডালাওয়ালা (সাধারণভাবে বহুবিবাহ প্রচলন) থেকে নিরুৎসাহন প্রকাশ করে।
৩. ফাতেমি সুন্নত ও মোহরের প্রসঙ্গ:
আপনার উত্থাপিত প্রশ্ন—মহরে ফাতেমি যদি সুন্নত হয়, তবে বহুবিবাহ পরিহারে ফাতেমা (রা.)-এর ঘটনা সুন্নত নয় কেন?
উত্তর বিশ্লেষণধর্মী:মহরে ফাতেমি মূলত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন, যা বিনয়, সাদামাটা ও খরচে পরিমিতির শিক্ষা দেয়। এটি আনুপাতিক সুন্নত হিসেবে গণ্য।
আর ফাতেমা (রা.)-এর বিষয়টি একটি পারিবারিক, আবেগীয় ও মানবিক বাস্তবতা, যেখানে অন্যায়ের আশঙ্কা বা কষ্টের সম্ভাবনা ছিল। এটি ব্যক্তিগত সুন্নাহ নয়, বরং সামাজিক নীতিবোধের দৃষ্টান্ত।
তবে এটিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে বলা যায়, যেখানে বহুবিবাহ কোনো নারীকে মানসিকভাবে আঘাত করে, সেখানে তা থেকে বিরত থাকাই উত্তম, যেমন আল্লাহর রাসূল (সা.) করলেন।
৪. অন্যান্য সম্পর্কিত হাদীস “أفضلُ النكاحِ أيسرُه.”
رواه ابن حبان (৪০৭২), والحاكم (২/১৮৩)
অনুবাদ:“সবচেয়ে উত্তম বিয়ে সে, যা সবচেয়ে সহজ-সরল।”
এ হাদীস মহর বা খরচ বৃদ্ধির বিপরীতে সহজ বিয়েকে উৎসাহিত করে। একাধিক বিবাহকে জটিল ও খরচবহুল করার মাধ্যমে তা সমাজে নিয়ন্ত্রণেরও উপায় হতে পারে।
“ما تركت بعدي فتنة أضر على الرجال من النساء”
رواه البخاري (৫০৯৬)
অনুবাদ:“আমার পরে পুরুষদের জন্য নারীর চেয়ে অধিক ক্ষতিকর কোনো ফিতনা রেখে যাইনি।”
এই হাদীস অনিয়ন্ত্রিত ভোগবাদী বহুবিবাহের বিপদের দিকটি ইঙ্গিত করে।
একাধিক বিয়ে শরীয়ত অনুমোদিত, তবে তা শর্তাধীন এবং দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত।
হাদীস ও নবীজির জীবন থেকে বোঝা যায়, তিনি নিজে বহুবিবাহ করলেও, ফাতেমা (রা.)-এর বেলায় দ্বীতিয় বিবাহকে নিরুৎসাহিত করেন।
ইসলামী ইতিহাসে সাহাবাদের রুচি
বেশিরভাগ সাহাবাই এক বা প্রয়োজনে দুই স্ত্রী নিয়েই জীবন অতিবাহিত করেছেন। আবু বকর (রা.), উসমান (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), আবু হুরাইরা (রা.)—এরা কেউই বহুবিবাহে উৎসাহ দেননি, বরং দাওয়াত ,জিহাদ, খেলাফতের দায়িত্ব, ইবাদত ও দ্বীনি খেদমতে জীবন কাটিয়েছেন।
তাই বহুবিবাহে আগ্রহীরা কেবল হালাল হওয়াকে যথেষ্ট মনে না করে, আত্মসমালোচনার সাথে বিশ্লেষণ করুন—আপনি ন্যায়বিচার করতে পারবেন কি না।
বহুবিবাহকে এমনভাবে প্রচার করছে যেন এটা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ!মাসনা সুলাসা রুবায়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এরা ধর্মকে উপহাসের পাত্র বানিয়ে ফেলেছে। এটা ছাড়া যেন ইমান অপূর্ণ থেকে যায়!
চলুন দেখা যাক ইমামগণ এ ব্যাপারে কী বলেছেন,
১. ইমাম আলাউদ্দিন আল মারদাওয়ি (রহ.)
আরবি: يُسْتَحَبُّ أَلَّا يَزِيدَ عَلَى وَاحِدَةٍ
বাংলা অর্থ:
“মুস্তাহাব হলো একটির বেশি বিয়ে না করা।”
সূত্র:আল ইনসাফ, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ১৬
২. ইমাম ইবনে কাজি আল-জাবাল (রহ.)
আরবি: لا ينبغي أن يتزوج بأكثر من واحدة
বাংলা অর্থ:“একের অধিক বিয়ে করা উচিত নয়।”
সূত্র:আল ফায়িক – ইবনে কাজি আল-জাবাল
৩. ইমাম আল নাজিম (রহ.)
আরবি: الواحدة أقرب إلى العدل
বাংলা অর্থ:“একজন স্ত্রী গ্রহণ করাই ন্যায়ের অধিক নিকটবর্তী।”
৪. ইমাম আলি ইবনে মুহাম্মাদ আল বালি (রহ.)
আরবি:وهذا هو المشهور: لا ينبغي أن يتزوج بأكثر من واحدة
বাংলা অর্থ:“এটাই প্রসিদ্ধ মত: একাধিক বিবাহ করা উচিত নয়।”
সূত্র:তাজরিদুল ইনায়াহ, আলি আল বালি
৫. ইমাম ইবনু খতিব (রহ.)
আরবি:أكثر أئمتنا استحبوا الاقتصار على الواحدة
বাংলা অর্থ:“আমাদের অধিকাংশ ইমামগণ একটির বেশি বিয়ে না করাকে পছন্দ করেছেন।”
সূত্র:আল ইনসাফ, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ১৬
৬. ইমাম শাফেয়ি (রহ.)
আরবি:أُحِبُّ للرجل أن يقتصر على واحدة، وإن كان له أن يتزوج أكثر من واحدة، لقول الله تعالى: ﴿فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً﴾
বাংলা অর্থ:“আমি পছন্দ করি পুরুষ যেন কেবল একটি বিয়েতেই সীমাবদ্ধ থাকে, যদিও একাধিক বিয়ে বৈধ। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে, ইনসাফ করতে পারবে না, তবে একটি।’”
সূত্র:আল বায়ান ফি মাজহাবি ইমাম আশ-শাফেয়ি, খণ্ড: ১১, পৃষ্ঠা: ১৮৯–১৯০
৭. ইবনে দাউদের আপত্তি ও উত্তরের সারাংশ:
আপত্তি: “আপনি কেন বললেন একটিতে সীমাবদ্ধ থাকতে, অথচ রাসুলুল্লাহ ﷺ বহু বিবাহ করেছেন?”
উত্তর:
“নবী ﷺ এর ক্ষেত্রে ইনসাফ না করার শঙ্কা ছিল না, কিন্তু অন্যদের পক্ষে এটি কঠিন। তাই তাদের জন্য একটি বিয়েই উত্তম।”
৮. ইমাম আশ-শিরবিনি (রহ.)
আরবি: السنة أن لا يجاوز الواحدة إلا لضرورة ظاهرة
বাংলা অর্থ: সুন্নাত হলো, প্রকাশ্য ও জরুরি কারণ ছাড়া একাধিক বিয়ে না করা।”
সূত্র:মুগনি আল মুহতাজ, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৭
৯. হাদীসের দলিল:
আরবি:”تزوجوا الولود الودود، فإني مكاثر بكم الأمم يوم القيامة”
বাংলা অনুবাদ:“তোমরা এমন নারীদের বিবাহ করো, যারা সন্তানবতী ও প্রেমময়ী, কেননা আমি কিয়ামতের দিনে তোমাদের সংখ্যা দ্বারা গর্ব করব।”
সূত্র:আবু দাউদ (২০৫০), নাসাঈ (৩২২৭), সহীহুল জামে (১৮০৫)
মন্তব্য: এই হাদীস সংখ্যাবৃদ্ধি উৎসাহিত করেছে—স্ত্রীর সংখ্যা নয়, বরং উম্মতের সংখ্যা।
১০. ইমাম ইবনে কুদামা (রহ.)
আরবি:ولا يُستحبُّ له أن يجمعَ بين أكثر من واحدةٍ، إلا لحاجةٍ
বাংলা অর্থ:“কোনো প্রয়োজন না থাকলে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা মুস্তাহাব নয়।”
সূত্র:আল মুগনী, খণ্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ৩৪৯
ফোকাহদের মতামতের রসংক্ষেপে:
ইমাম বক্তব্য সুপারিশ
মারদাওয়ি: একটির বেশি বিয়ে মুস্তাহাব নয় । সীমিত থাকাই উত্তম
ইবনে কাজি: একাধিক বিয়ে উচিত নয়, সীমাবদ্ধতা
শাফেয়ি :একটি উত্তম, যদিও বৈধ, সতর্কতা
শিরবিনি :প্রয়োজন ছাড়া একাধিক নয়, প্রয়োজন ভিত্তিক
ইবনে কুদামা: প্রয়োজন ছাড়া একাধিক বিয়ে মুস্তাহাব নয় , সীমিত।
৬
দেখেন বহুবিবাহ সম্পর্কে উপমহাদেশের হানাফী মুফতিদের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য রেফারেন্স-বই ফাতাওয়া আলমগীরী-তে কী বলা হয়েছে :
“যদি কারো একজন স্ত্রী থাকে এবং সে আরেকটি বিয়ে করতে চায়, তার যদি ভয় থাকে যে সে তাদের মধ্যে সমতা ও ন্যায় রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে তার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করার সুযোগ নেই। যদি এ রকম কোনো ভয় না থাকে, তাহলে সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে। তবে দ্বিতীয় বিয়ে থেকে বিরত থাকাই উত্তম এবং স্ত্রীকে দুঃখ দেওয়া থেকে বিরত থাকার কারণে সে সওয়াব পাবে।”
-ফাতাওয়া আলমগীরী ৭/ ৪৭৮
হানাফী ফকীহ সিরাজুদ্দীন ইবনে নুজাইম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যদি কেউ স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকার উদ্দেশ্যে একাধিক বিয়ে না করে, তাহলে সে সওয়াব পাবে। স্ত্রীকে কষ্ট না দেওয়া ইবাদত ও সওয়াবের কাজ এবং উত্তম হলো এক বিয়েতেই সীমাবদ্ধ থাকা।
-আন-নাহরুল ফায়েক শরহু কানযিদ-দাকায়েক
তাই আমভাবে, শর্তহীন কেবল নিজের নফসানিয়্যাত ও খায়েশাত পূরণের নিমিত্তে বহু বিবাহ করা কিংবা এর জন্য অন্যকে উৎসাহিত করা, কিংবা এটিকে মিশন বানিয়ে কাজ করার সুযোগ ইসলাম আপনাকে ডালাওবাবে অনুমতি দেয় নি। কারো প্রয়োজন হলে শর্ত সাপেক্ষ এটিকে জায়েজ করা হয়েছে নিরুৎসাহিতভাবে। যেমন একইভাবে তালাককে নিরুৎসাহিত ও ঘৃণিত কাজ হিসাবে বিবেচনায় করেই প্রয়োজনে শর্ত সাপেক্ষ জায়েজ করা হয়েছে নিরুৎসাহিতভাবে। তালাক নিয়ে যেমন মার্কেটিং করার সুযোগ নেই তেমনি মাসনা নিয়েও উৎসাহিত করার সুযোগ ইসলামে দেয়া হয় নি।
আজকাল কিছু মুসলিম পুরুষ কুরআনের আয়াত উদ্ধৃতি করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করেন, কিন্তু তাদের চরিত্র, উদ্দেশ্য ও পারিবারিক দায়িত্ববোধ প্রশ্নবিদ্ধ। একাধিক স্ত্রীর প্রতি মানসিক, আবেগিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার না করে শুধু যৌনতার খাতিরে বিয়ে করলে তা ইসলামের চেতনার পরিপন্থী।
বহুবিবাহ ফরজ বা মুস্তাহাব নয়, বরং একটি শর্তাধীন বৈধতা।
ইসলাম বহুবিবাহকে অত্যাবশ্যক (ফরজ) কিংবা উপদেশযোগ্য (মুস্তাহাব) করে নি।এটি একটি সামাজিক প্রয়োজন ও বিশেষ পরিস্থিতির ভিত্তিতে অনুমোদিত ব্যবস্থা মাত্র।
. বহুবিবাহ বৈধ, তবে তা শর্তসাপেক্ষ।
প্রধান শর্ত হলো: ন্যায়বিচার বা সমতা (عدل) বজায় রাখা।
এ আয়াতে “فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا” বাক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি বলে দেয় যে, ন্যায়বিচার করতে না পারার আশঙ্কা থাকলেও বহুবিবাহ বৈধ নয়।
এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, আত্মিক, মানসিক ও আচরণগত সমতা প্রায় অসম্ভব, ফলে একাধিক বিবাহ একটি অত্যন্ত জটিল দায়িত্ব।
“যে ব্যক্তি দুই স্ত্রী রাখে এবং তাদের মাঝে সমতা বজায় রাখে না, সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আসবে যে, তার এক পাশ ঝুলে থাকবে।”
(সুনানে আবু দাউদ: ২১৩৩, সুনানে তিরমিজি: ১১৪১, সহীহ হাদীস
এটি একাধিক বিবাহের দায়িত্ব কতটা জটিল, তা স্পষ্ট করে দেয়।
সারসংক্ষেপ:
১. বহুবিবাহ ফরজ নয়, বরং প্রয়োজনের ভিত্তিতে বৈধ।
২. সমতা (عدل) বিধানের শর্ত রয়েছে।
৩. সমতা সম্ভব না হলে একটির বেশি বিবাহ নিষিদ্ধ।
৪. সমতা রক্ষা করা ফরজ।
৫. ইসলাম বহুবিবাহকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেনি, তবে নিরুৎসাহিত করেছে।
উপসংহার:
ইসলামে বহুবিবাহ কোনো ভোগবাদী জীবনধারার অনুসঙ্গ নয়। বরং এটি একটি দায়িত্বপূর্ণ সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অনুমোদিত হয়েছে। এ বিধান নারী ও সমাজের কল্যাণের কথা বিবেচনায় রেখেই নির্ধারিত, তবে এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আত্মসংযম, ন্যায়পরায়ণতা ও পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধ এর কঠিন শর্তাবলী।
লেখক: বহুগ্রন্থপ্রণেতা, অনুবাদক ও গবেষক ; মুহতামিম : জামিয়া কাশিফুল উলুম, ঢাকা; সম্পাদক: মাসিক দ্বীনী দাওয়াত