আমার বয়স যখন ৩/৪ মাস। শ্রদ্ধেয় আব্বাজী আওক্বাফের সম্মানিত ইমাম হয়ে কাতারে চলে আসেন। আব্বাজী জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন কাতারে, পরিবারের জন্য, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের জীবনেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। বড় হয়েছি, পড়ালেখা করেছি, জীবন ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে।
সময় ঘুরে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ালাম, যখন আমিও আব্বাজীর মতোই কাতারের আওক্বাফের অধীনে ইমাম হিসেবে মনোনীত হলাম আলহামদুলিল্লাহ । সংবাদটি শুনে আব্বাজীর আনন্দের যেনো কোনো সীমা রইল না। যেনো তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রম ও ত্যাগের ফসল তিনি নিজের চোখে দেখতে পেলেন। তাঁর অনেক দিনের পুষে রাখা স্বপ্ন যেনো তাঁর ছেলের মাধ্যমে পূরণ হলো।
আব্বাজি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন আমার ফ্লাইটের। ২০১৭ সালের ১৬ই জুলাই কাতারে আসার দিন নির্ধারণ হলো। আব্বাজী আর ওয়াসীম ভাইসাব আমাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে ছিলেন। ১৭ই জুলাই আমি কাতারে পা রাখি।
একই দেশে এবং একই দায়িত্বের অংশীদার হওয়া আর পাশাপাশি থাকা—এই অনুভূতিগুলো সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি কাতারে আসার কিছুদিন পর আব্বাজী ৩ মাসের জন্য বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমিও আওক্বাফের অধীনে হওয়ায় আব্বাজীর পরিবর্তে বদীল হিসেবে আব্বাজীর মসজিদ -মদীনা মুররাতে- আমাকেই পাঠানো হয়। ব্যাপারটা আমাদের বাপ-বেটার যতটুকু আনন্দের ছিলো. কিছু কিছু মুসল্লিদের কিছু সুন্দর মন্তব্যে মনে হতো তারাও যেনো আমাদের মতই খুশি হয়েছিলেন।
কেউ কেউ তো বলেছিলেন, ماشاءالله- الولد سر أبيه। এর অর্থ হলোঃ বাপ-কা বেটা. বাবার মতই ছেলে। আমি মনে মনে বলি– يا ليت كان ظنّهم صوابًا . যদি তাদের ধারণাটা সত্য হতো!
২
কাতারে আমার ছোট্ট বাসাটা আব্বাজীর খুব প্রিয় ছিল। সাপ্তাহিক ছুটি আমার এখানে কাটাতেই পছন্দ করতেন। আমিও অপেক্ষায় থাকতাম। আসার সময় অনেক কিছু নিয়ে আসতেন। গত কয়েকটা দিন বাসাটা যেনো অন্যরকম ছিল। পরিচিত দেয়ালগুলোও নতুন করে কথা বলছিল কারণ, আব্বাজী ছিলেন আমার বাসায়।
নামাজের পর আব্বাজী মসজিদে কিছুক্ষণ বসে থাকা, নামাজে তেলাওয়াত করা, শান্ত গলায় দোয়া পড়া, একসাথে চা খেতে খেতে হালকা কথাবার্তা বলা—সব কিছুতেই যেনো একধরনের প্রশান্তি মিশে ছিল। এমনকি আব্বাজীর চুপচাপ বসে থাকা কিংবা কোনকিছু করতে থাকার দৃশ্যটাও আমার মন ভরে দিত।
গত কয়েকদিন এমন মধুর কিছু সময় কাটানোর পর এখন আব্বাজীর চলে যাওয়ায় বাসা’টা যেনো একদম নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। প্রতিটি কোণায় যেন আব্বাজীর ছোঁয়া লেগে আছে। সবকিছুতেই আব্বাজীর অনুপস্থিতি খুব মিস করছি।
৩
ছোটবেলায় আমরা ছিলাম দেশে, আব্বাজী ছিলেন কাতারে —অপেক্ষা ছিল, চিঠি ছিল, ফোনে কথা বলার আনন্দ ছিল। বাড়িতে যখনই কাতার থেকে কোনো চিঠি পৌঁছত – দৌড়ে গিয়ে আগে দেখতাম এবারের চিঠি’টা কার নামে এসেছে। আব্বাজী টেপ-রেকর্ড করে চিঠির খামে ভরে আমাদের জন্যে কথা বলে পাঠাতেন। আমরা আব্বাজীর মুখে আমাদের নাম শুনে যারপরনাই খুশি হতাম। আমরাও তিলাওয়াত, নাত কথা এবং নিজেদের ইচ্ছা সবকিছু রেকর্ড করে আব্বাজীর জন্যে পাঠাতাম। আর আব্বাজী একা একা আমাদের সবার থেকে এতো দূরে থেকে আমাদের ইচ্ছে গুলো পূরণ করতেন।
আর এখন আমরা কাতারে, আব্বাজী বাংলাদেশে। সময়ের পরিবর্তনে শুধু জায়গাগুলো বদলেছে, মানুষও কিছুটা, কিন্তু অনুভূতিগুলো ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। মনে হয়, একটা আবেগঘেরা অধ্যায়ের পর্দা নামল।
কি আজিব! সময় বদলায়, গল্প বদলায়, কিন্তু ঘুরেফিরে আমরা যেনো আবার সেই পুরনো দূরত্বের কাছে এসে দাঁড়াই। বড় হয়ে গেছি বলে ইচ্ছে হলেই কাঁদতে পারিনা। সবশেষে বিমানে উঠিয়ে দিয়ে কল করে বিদায় নিচ্ছিলাম। তখন যেনো নিজেকে আটকে রাখার আর শক্তি ছিলোনা। আব্বাজী জবাবে বলছিলেন এটাই দুনিয়ার নিয়তি। আখেরাতের চিন্তা কর- ভালো থাকিস। দোয়া করিস।
আল্লাহ তায়ালা আব্বাজীর নতুন জীবন পর্বকে সুস্থতার সাথে সুখ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করুন।