ইসরায়েল ত্রাণ সরবরাহে বিধিনিষেধ দেওয়ায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে গাজার ২০ লাখ বাসিন্দা। ছবি: রয়টার্স
“এটা যা আমাদেরকে তা বলতেই হবে। এটা উগ্রবাদ, এটা বিপজ্জনক, এটা ঘৃণ্য, এটা ভয়াবহ। আমি সবচেয়ে কঠোর ভাষায় এর নিন্দা জানাচ্ছি,” গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত যুদ্ধ ও ত্রাণ প্রবেশে বাধা নিয়ে বলেছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি।
গাজায় ইসরায়েলের ‘মারাত্মক উন্মাদনার’ বিরুদ্ধে ইউরোপ ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করায় ক’দিন আগে ইসরায়েলি উদারপন্থি দৈনিক হারেৎজ কড়া সতর্কবার্তা দিয়ে লিখেছিল, ‘কূটনৈতিক সুনামি এগিয়ে আসছে’।
তেল আবিবের ওপর গত এক সপ্তাহে যত কূটনৈতিক আঘাত এসেছে, তার কয়েকটি সম্ভবত তাদের কল্পনাতেও ছিল না।
গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত আন্তর্জাতিক নিন্দা থেকে শুরু করে ওয়াশিংটনে দুই দূতাবাসকর্মীর নির্মম হত্যাকাণ্ড, সব মিলিয়ে, খানিকটা মৃদু ভাষায় বললেও, ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রটি এই এক সপ্তাহ টালমাটাল এক সময় পার করেছে, বলছে বিবিসি।
আক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়া শুরু করে সোমবার ইউরোপের সময় সন্ধ্যায়, যখন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা এক যৌথ বিবৃতিতে গাজায় তেল আবিবের ‘জঘন্য’ কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়।
ইসরায়েল যদি তার নতুন করে শুরু করা সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখে এবং মানবিক ত্রাণ ঢোকায় বিধিনিষেধ প্রত্যাহার না করে তাহলে ‘আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে’ বলে সতর্কও করে তিন দেশ।
দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের প্রতিক্রিয়ায় ‘সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা’ আরোপেরও হুমকি দেয় তারা।
এই ধারাবাহিকতায় ২৪টি দাতা দেশ এক বিবৃতিতে গাজায় ইসরায়েল-সমর্থিত নতুন ত্রাণ সরবরাহ মডেলের নিন্দা জানায়।
এগুলো ছিল কেবলই শুরু।
মঙ্গলবার ব্রিটেন ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করে এবং ভবিষ্যৎ সহযোগিতার লক্ষ্যে ২০২৩ সালের রোডম্যাপ পর্যালোচনার ঘোষণা দেয়।
তারা ডেনিয়েলা ওয়েইসসহ একাধিক ইহুদি সেটলারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। লুই থেরুর সাম্প্রতিক প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য সেটলারস’-এ ডেনিয়েলাকে দেখা গেছে।
এখানেই থামেনি ডাউনিং স্ট্রিট, লন্ডনে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। এ ধরনের পদক্ষেপ যুক্তরাজ্যকে সাধারণত রাশিয়া বা ইরানের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে নিতে দেখা যায়।
এরপর আরও বড় আঘাত আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কালাসের কাছ থেকে। তিনি বলেন, তাদের ২৭ দেশের জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ইসরায়েলের সঙ্গে ২৫ বছর পুরনো সমঝোতা চুক্তিটি নতুন করে পর্যালোচনার পক্ষে।
‘এনাফ ইজ এনাফ’
এই যে কূটনৈতিক এ নিন্দার ঝড়, তার কারণ তো স্পষ্ট।
তথ্যপ্রমাণ বলছে, ২০০৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলা পাল্টায় তেল আবিব যুদ্ধে নামার পর অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় গাজা এখন দুর্ভিক্ষের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। এটাই বিশ্বকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, আর একে কেন্দ্র করে তেল আবিবের কট্টরপন্থি রাজনীতিকদের নানান হুমকি-ধামকিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ডটির পরিস্থিতি যে আরও অবনতির পথে, সেটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল।
এসব কারণেই মঙ্গলবার এমপিদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তৃতায় যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামিকে দেখা যায় ভিন্নরূপে।
তিনি ইসরায়েলের কট্টরপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচের গাজা ‘পরিষ্কার’, ‘অবশিষ্ট যা আছে তা ধ্বংস’ এবং ভূখণ্ডটির বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করে যা যা বলেছিলেন তা তুলে ধরে তেল আবিবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন।
“এটা যা আমাদেরকে তা বলতেই হবে। এটা উগ্রবাদ, এটা বিপজ্জনক, এটা ঘৃণ্য, এটা ভয়াবহ। আমি সবচেয়ে কঠোর ভাষায় এর নিন্দা জানাচ্ছি,” বলেছেন ল্যামি।
গাজায় যুদ্ধ নিয়ে যারা সিদ্ধান্ত নেন, স্মতরিচ তাদের মধ্যে পড়েন না। আগে সাধারণত এ ধরনের কারও উত্তপ্ত বক্তব্যকে ইউরোপীয় নেতারা গোনায় ধরতেন না।
কিন্তু সেসব দিন শেষ হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। কেননা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকেও দেখা যাচ্ছে তার কট্টর-ডানপন্থি সহকর্মীদের সঙ্গে গলা মেলাতে।
সমালোচকরা তার বিরুদ্ধে অহেতুক যুদ্ধ চালানো, ফিলিস্তিনি বেসামরিক বা ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীদের হাতে থাকা অবশিষ্ট জিম্মিদের জীবনের তোয়াক্কা না করার অভিযোগ আনছেন।
তাই তো যেসব দেশ দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের’ পক্ষে ছিল তারা এখন বলা শুরু করেছে, ‘এনাফ ইজ এনাফ (যথেষ্ট হয়েছে)’ ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের কথা। এই সেদিনও তিনি ছিলেন ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক। গত বছর গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো নিয়ে তার অনাগ্রহের সমালোচনা খোদ তার দল লেবার পার্টির লোকজনই করেছিল।
অথচ মঙ্গলবার সেই একই ব্যক্তি বলেছেন, গাজার নিষ্পাপ শিশুদের দুর্ভোগ ‘আর নেওয়াই যাচ্ছে না’।
শক্তিশালী কয়েক মিত্রের কাছ থেকে এমন সমন্বিত নিন্দাকেও পাত্তা দিচ্ছে না ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু উল্টো যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডাকে হামাসের পক্ষ নেওয়ার দায় দিয়েছেন।
“যখন গণহত্যাকারী, ধর্ষক, শিশু হত্যাকারী ও অপহরণকারীরা আপনাদের ধন্যবাদ জানায়, তখন আপনারা ন্যায়বিচারের বিপরীত দিকে থাকেন। মানবতার বিপরীত দিকে, ইতিহাসের ভুল পাশে থাকেন,” এক্সে দেওয়া পোস্টে এমনটাই লিখেছেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’র তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। বুধবার রাতে ওয়াশিংটনে ইয়ারন লিশিনস্কি ও সারা লিন মিলগ্রাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে স্টারমারসহ ইসরায়েলের সমালোচকদের ‘সরাসরি সংযোগ’ আছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
বিশ্ব এ দুই ইসরায়েলি দূতাবাসকর্মীর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে, সহানুভূতিও উপচে পড়ছে। তা সত্ত্বেও ইসরায়েলি সরকার ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তাদের পশ্চিমা মিত্রদের পাশাপাশি প্রবাসী ইহুদিদের মধ্যে খ্যাতনামা অনেকেই গাজায় যুদ্ধ নিয়ে জোর গলায় ক্ষোভ ও বেদনার কথা জানাচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যের সাবেক মধ্য প্রাচ্য বিষয়ক দূত এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের উপদেষ্টা লর্ড লেভি বলেছেন, তিনি বর্তমান ব্রিটিশ সরকার যেভাবে ইসরায়েলের সমালোচনা করছে তার সঙ্গে একমত। এক্ষেত্রে ‘খানিকটা দেরি হয়ে গেছে’ বলেও মত তার।
“গাজায় যা কিছু ঘটছে তার বিরুদ্ধে কেবল আমাদের দেশ নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও একটি কঠোর অবস্থান নিতে হবে,” বিবিসি রেডিও ফোরকে এমনটাই বলেছেন লেভি। নিজেকে যিনি পরিচয় করিয়ে দেন এইভাবে- ‘খুবই গর্বিত ইহুদি, ইসরায়েলের প্রতি যার রয়েছে গভীর ভালোবাসা’।
কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও একজন চুপ, যিনি চাইলেই এ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেন।
সম্প্রতি উপসাগরের তিন দেশ সফরের শেষদিকে ডনাল্ড ট্রাম্প গাজাকে ইঙ্গিত করে বলেছিলে, “অনেক মানুষ অনাহারে রয়েছে।”
হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তাদের ইঙ্গিত, গাজার যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতাশ এবং তিনি চান, ইসরায়েলের সরকার যেন দ্রুত এর ‘সমাপ্তি টানে’।
কিন্তু অন্য পশ্চিমা নেতারা যখন তেল আবিবের নৃশংসতা নিয়ে মুখ খুলছেন, ট্রাম্প তখন একেবারেই চুপ। ইউক্রেইন যুদ্ধ থেকে শুরু করে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত সব বিষয়ে তার তীক্ষ্ণ নজর, কিন্তু গাজা যুদ্ধ নিয়ে তিনি যেন মুখে ‘তালা লাগিয়েছেন’।